নারীদের সাহসী করে তোলার মতো এক পুলিশি ছবি ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’। কর্মফল নামটা কেন যুক্ত করা হয়েছে সেটা বোঝার জন্য শেষ দৃশ্য পর্যন্ত অপেক্ষা করার এক ছবি এটি। বার বার মুক্তির তারিখ পেছানো এবং প্রচারণা না চালানোর মতো এক অবহেলিত ছবি, খুনের রহস্য উদঘাটনের উদাহরণ হয়ে থাকা বাস্তব সম্মত এক ছবি ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’।
‘রেহানা মারিয়াম নুর’-এর পর অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের দারুণ অভিনয়সমৃদ্ধ এক ছবি ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’। ক্যান্সার আত্রান্ত বাবাকে বাঁচানো আর জীবন সংগ্রামে বারবার পরাজিত হতে থাকা এক নারীর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক ছবিও ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’। নার্সিং কলেজের ছাত্রী এশা। দুই বান্ধবী তার। তপু নামের এক ছেলে তাকে ভালোবাসে। যদিও সে তার পেশা নিয়ে এশাকে মিথ্যে বলে। ক্ষেপাটে প্রকৃতির নাসিরও এশাকে ভালোবাসতে চায়। এশার বাবার ক্যান্সার। সে টিউশনি ও পার্ট টাইম চাকরি করে সবকিছু সামাল দিতে চেষ্টা করে। তপুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে এশা। সুন্দর এই মেয়েটার আর্থিক অসুবিধের সুবিধা নিতে চায় অনেকে। একদিন খুন হয় মেয়েটা। ধর্ষণের পর তার মাথাটা কেটে নিয়ে যায় খুনি। খুনের দিন ময়মনসিংহের ঐ এলাকায় বদলি হয়ে আসেন পুলিশ অফিসার এএসপি লীনা। এশা খুনের তদন্তভার পড়ে লীনার উপর। শুরু হয় ছবির আসল গল্প।
ছবিতে এশার চরিত্রে অভিনয় করেছেন পূজা এগনেস ক্রুজ। সিনেমায় নতুন হলেও ভালো করেছেন তিনি। পুলিশি গল্প বিধায় অনেক পুলিশ চরিত্র ছিল ছবিতে। ওসি সিরাজুলের চরিত্রে মজার অভিনয় করেছেন ফারুক আহমেদ। তার ‘হিসাব বরাবর’ ডায়ালগটা জনপ্রিয় হয়েছে।
ইন্সপেক্টর শফি চরিত্রে সরকার রওনক রিপন এবং এস আই শামীম চরিত্রে হাসনাত রিপন ভালো করেছেন। এশার প্রেমিক তপুর চরিত্রে নিবিড় আদনান এবং নাসিরের চরিত্রে শরীফ সিরাজ অভিনয় করেছেন। ক্ষাপাটে ও খানিক প্রতিশোধ পরায়ন চরিত্রে শরীফ সিরাজ বেশ ভালো করেছেন। এএ্সপি লীনার বসের চরিত্রে এ কে আজাদ সেতু, বেকারি মালিকের চরিত্রে মিশা সওদাগর, বাড়িওয়ালার চরিত্রে শতাব্দী ওযাদুদ ও তার স্ত্রীর চরিত্রে সুষমা সরকার মানানসই ছিলেন। খুনীর চরিত্র বেশ ছোট হলেও মানিয়ে গেছেন সৈয়দ এজাজ আহমেদ। তার নৃশংস হাসি মনে রাখার মতো।
তবে এএসপি লীনার চরিত্রে দারুণ ভালো ও স্মার্ট অভিনয় করেছেন আজমেরি হক বাঁধন। তার অভিনয় জীবনে মনে রাখার মতো আরেকটি ছবি এটি। ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’ ছবির পরিচালক সানী সানোয়ার যিনি আগে ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘ব্ল্যাক ওয়ার’, ‘মিশন এক্সট্রিম ২’-এর মতো ছবির সাথে জড়িত ছিলেন। সিনেমার চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি। সানী সানোয়ার পুলিশি মানুষ বলে পুলিশি গল্পের ওপর তার দখল থাকা স্বাভাবিক। তার আগের ছবিগুলোর চেয়ে এই ছবির বাজেট অনেক কম। ছবিতে আরোপিত অ্যাকশান কিংবা আইটেম গান নেই। নেই পুলিশই সব পারে এমন বয়ান। বরং এক নারী পুলিশ অফিসার পদে পদে যে বাঁধা অতিক্রম করে তার নীরব ছোঁয়া আছে এই ছবিতে। আছে ক্লু না থাকা এক খুনের ঘটনার খানিক ধীরগতির তদন্তের বাস্তব রূপ দেয়ার চেষ্টা।
একটা গানের কথা আলাদা করে বলা যায়। সালমান জেমের কন্ঠে ‘বন্দী শুধু জানে মুক্ত হওয়ার মানে’ গানটা ভালো লেগেছে। গানটি লিখেছেন রাসেল মাহমুদ এবং সঙ্গীতায়োজন করেছেন জাহিদ নীরব।
ছবির আরেক ভালো দিক এর দৃশ্যায়ন। সুদীপ্ত মজুমদার ছবির কাহিনীর মতো দৃশ্যায়ন করেছেন। ছবির রং তাই ঝকঝকে নয়, গ্রামও তেমন সবুজ নয়। সব যেন ছবির বিষয়বস্তুর মতো বিষন্ন।
পুলিশি গল্প বলে ছবির কিছু ভিন্ন দিকও উল্লেখ করা যায়। ভালোবাসা দিবসের পর তিন তিনটে খুন হলেও এর কোনও প্রচারণা ছিল না সংবাদ পত্র বা মিডিয়ায়। বাবা-মার দুর্বলতার কারণে কেউ যদি সাইকো বা সিরিয়াল কিলার হয়, কীভাবে হয় তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা নেই ছবিতে। এশার প্রেম যতোটা আছে ছবিতে, জীবন সংগ্রাম ততোটা জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়নি। অনেকে বলতে পারেন এটা সিআইডি সিরিজ বা শেষমেষ পুলিশি গল্প। তবু এক নারীর চাকরি ক্ষেত্রে বাধা, নারী বলে দমিয়ে রাখা, শেষমেষ তদন্তের সবগুলো দিকের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগের মাধ্যমে খুনী শনাক্ত করা, পুলিশকে সুপার হিউম্যান না বানানো এমন কিছু ভালো দিক আছে।
সবচেয়ে ভালো দিক জানতে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ছবির। তখন বোঝা যাবে কর্মফল শব্দটা কেন ছবির নামের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতি হয়তো অনেক কিছু সয়ে নীরব থাকে কিন্তু ছেড়ে দেয় না কাউকেই।
ছবির শুটিং শেষ হয়েছিল বেশ আগে। ২০২৪ এর রোজার ঈদেই মুক্তির কথা শোনা গিয়েছিল। এক বছরেরও বেশি সময় পরে মুক্তি দেয়া হলেও ছবির প্রচারণা ছিল না বললেই চলে।
ছবি মুক্তির দিন থেকে ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যে শ্রম দিয়েছেন, পরিচালককে তেমনি দেখা যায়নি এই কাজে। তবু এই ছবির পরিচালক অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে ভিন্নধর্মী এক চেষ্টায় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার জন্য। জয় হোক বাংলা ছবির।
‘এশা মার্ডার: কর্মফল’
কাহিনি: হাসানাত বিন মতিন, সানী সানোয়ার
পরিচালক: সানী সানোয়ার
অভিনয়: আজমেরী হক বাঁধন, পূজা ক্রুজ, ফারুক আহমেদ
মুক্তি: ৭ জুন ২০২৫
সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
আরও সমালোচনা:
‘জংলি’ ৫/১০: জন্ম না দিয়েও আদর্শ বাবা হতে পারার ছবি
‘চক্কর ৩০২’ ৭/১০: গল্পের চক্করে ভরা এক ছবি
‘দাগি’ ৭/১০: প্রায়শ্চিত্তের গ্লানি মাখা এক ছবি
‘বরবাদ’ ৫/১০: শিশুদের নিয়ে না দেখার মতো ছবি
৮৪০: রহস্যময়তার আড়ালে মজাদার এক রাজনৈতিক স্যাটায়ার
দরদ: দরদহীন নির্মাণের এক প্রশ্নবিদ্ধ ছবি!
৩৬-২৪-৩৬: সিনেমার পর্দায় ‘ওটিটি কনটেন্ট’
তুফান: সন্ত্রাসকে গ্ল্যামারাইজ করতে চাওয়া এক ছবি
ফাতিমা: সাধারণ এক নারীর ‘অসাধারণ’ সংগ্রামের ছবি
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
হুব্বা: সামথিং লাইক আ ক্রিমিনাল’স অটোবায়োগ্রাফি!
খুফিয়া: বাংলাদেশ নিয়ে ‘শঙ্কা ও ভাবনার’ ভারতীয় ছবি!
অন্তর্জাল: সাইবার থ্রিলার নিয়ে স্মার্ট ছবি
এমআর-৯: ‘মাসুদ রানা’ আছে ‘মাসুদ রানা’ নেই!
১৯৭১ সেই সব দিন: ৫৩ বছর আগের বাস্তবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা
আম কাঁঠালের ছুটি: দুরন্ত শৈশব মনে করিয়ে দেয়া এক ছবি
প্রিয়তমা: পরিচিত গল্প আর ‘তাড়াহুড়ো’য় নির্মিত ছবি!
প্রহেলিকা: ছবিটি দেখলে কিছু প্রশ্ন উঠবেই
‘পরাণ’-এর আরেক ভার্সন ‘সুড়ঙ্গ’!
সুলতানপুর: ফর্মুলায় আক্রান্ত ধারাবাহিকতাহীন ছবি
আদিম: ‘বস্তি ঘনিষ্ঠ’ এক অপরূপ ছবি!
পাপ: শেষ না হওয়া এক থ্রিলার গল্পের ছবি
কিল হিম: বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনন্ত, কিন্তু সেটা নড়ে না!
লিডার: স্বস্তি আর অস্বস্তির পাঁচ-ছয়
লোকাল: রাজনীতির ব্যানারে প্রেম ও প্রতিশোধের ছবি!
জ্বীন: ‘জিন ছাড়ানো’র কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছবি!
মুজিব: ইতিহাস হয়ে থাকার মতো ছবি
আজব কারখানা: রকস্টারের জীবন নিয়ে ‘আজব’ এক ছবি