বাড়িটির বর্তমান মালিক নৃপেন্দনাথ সরকার। তিনি জানালেন, তার বাবা প্রয়াত প্রাণনাথ সরকার ফরিদপুরের রাজবাড়ি থেকে এসে এই বাড়িটি কিনে নেন নায়করাজের পরিবারের কাছ থেকে, ১৯৬৫ সালে। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন এই বাড়িতে আসি তখন পুরো বাড়িটাই ছিল ভাঙাচোরা। ৬৪ সালের দাঙ্গার সময় দুষ্কৃতকারীরা বাড়ির জানালা-দরজা সব ভেঙে ফেলেছিল। আমরা সেগুলো ঠিক করি। বাকি পুরো বাড়িটাই অবিকৃত আছে। এই বাড়ির পিছনের দিকে রাজ্জাক সাহেবের জমি ছিল, যেখানে ওর বাবা-মায়ের কবর ছিল। আজ তার চিহ্নমাত্র নেই। এই বাড়িতে উনি চানাচুরের কারখানা করেছিলেন। আর নাটকের মহড়া দিতেন।’
নায়করাজের বসতভিটা থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে খানপুর স্কুল। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত এই স্কুলটি এই এলাকার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। ২১ আগস্ট ২০১৭ সালে নায়করাজের মৃত্যুর সংবাদে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছিল স্কুলটিতে। প্রধান শিক্ষক সজল কুন্ডু বলেন, ‘আমাদের স্কুল থেকে উনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুপ্রেরণায় উনি প্রথম সরস্বতী পুজোর সময় নাটক করেছিলেন। এখান থেকে পাস করার পর চারুচন্দ্র কলেজে ভর্তি হন তিনি।’
খানপুর স্কুলের কর্মচারী উজ্জ্বল গায়েন এই প্রতিবেদককে স্কুলে ভর্তির নথি দেখান। এই নথির ৬০ ক্রমিক নম্বরে দেখা যাচ্ছে, ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে আকবর হোসেন মোল্লা তার পুত্র আবদুর রেজ্জাক মোল্লাকে নতুনহাটের খজ মজুয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল থেকে নিয়ে এসে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করেছেন। যখন তার পুত্রের বয়স ৭ বছর ১ মাস। জন্ম সাল ১ জানুয়ারি, ১৯৪৩।
বয়স প্রায় ৭০, চোখের দৃষ্টি হয়েছে ক্ষীণ, তবু পথ চেয়ে আছেন তিনি; এই বুঝি তার আলতা ভাই বাসার দুয়ারে এসে ডাকবেন- সফিরন কেমন আছিস? ছোটবেলায় ১৯ নাকতলা রোডের বাড়ি থেকে বিয়ের পর নরেন্দ্রপুর কারবালা রোডের কুসুম্বা মাঝের পাড়ার শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন সফিরন। স্বামী মহসীন আলি মণ্ডলের মৃত্যুর পর এখন তিন ছেলেকে নিয়ে থাকেন নায়করাজ রাজ্জাকের একমাত্র বোন সফিরন বিবি। তার এক ছেলে আবদুল হাই বলেন, ‘মামার মৃত্যুর খবর দেওয়ার পর থেকে মা শুধু কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, আলতা দাদা তুমি আর আসবে না? মা ও আমার রাজ্জাক মামার মধ্যে বয়েসের পার্থক্য কম ছিল বলে দুজনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলায় এদের বাবা-মা মারা যাওয়ার পর খুব কষ্ট করে মানুষ হয়েছিলেন দুজনে। মামা পেট চালানোর জন্য চানাচুর তৈরি করে বিক্রি করতেন। সেই সঙ্গে তার ছিল নাটকের নেশা। টলিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় চলে যেতেন সিনেমায় অভিনয় করার জন্য। সে অনেক স্মৃতি মায়ের কাছে শুনেছি। মামা ভালো গান করতেন। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় ওনার বাড়িঘর লুট করে দুষ্কৃতকারীরা ভেঙে দিলো, তখন বাধ্য হয়ে তিনি মামি আর বড় ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেলেন।’
আবদুল হাই আরও বলেন, ‘মামা কলকাতায় এলে আমাদের বাড়িতে আসতেন। বাড়ির শিশুদের নিয়ে মজা করতে ভালোবাসতেন। ওনার ইচ্ছা ছিল কলকাতায় নায়ক হওয়ার। কিন্তু তা হলো না। ঢাকায় গিয়ে নায়ক হলেন। কলকাতার ছেলে হলেও তিনি যে সম্মান বাংলাদেশে পেয়েছেন তা কিন্তু এখানে পাননি।’
শালা ছবি তুলছিস কেন, আমি কি মরে যাবো- ঠিক এভাবেই একমাত্র শ্যালক সালাউদ্দিনকে বকা দিয়েছিলেন নায়করাজ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কলকাতার পার্কসার্কাসে বসবাসরত মুহম্মদ সালাউদ্দিন মণ্ডল এমনটাই জানালেন। সালাউদ্দিন বলেন, ‘২০১৭-এর জুন মাসে শেষবারের মতো ওনার সাথে আমার কলকাতায় দেখা। এখানে এলে আমি ওনার সবসময় সাথে থাকতাম।’
তিনি বলেন, ‘উনি এলে বরাবর পার্কস্ট্রিটের লিটন হোটেলে ২১৩ নম্বর রুমে উঠতেন। প্রায় ৪০ বছর ধরে ওই হোটেলে তিনি এতবার থেকেছেন, একদিন হোটেল মালিক হাসতে হাসতে বলেছিলেন, রাজ্জাক ভাই আপনি যে টাকা রুমের ভাড়ার জন্য আমাকে দিয়েছেন, তা দিয়ে কলকাতায় একটা দামি ফ্ল্যাট কিনতে পারতেন। এই শহরকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। এখানে এলেই তিনি আমাকে নিয়ে চলে যেতেন নাকতলায়। পুরানো পাড়ায় ঘুরে বেড়াতেন। বন্ধুদের খোঁজ করতেন। ১৯ নম্বর নাকতলা রোডের বাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন আর চোখ মুছতেন। এই বাড়ি থেকেই একদিন রাতের অন্ধকারে চলে যেতে হয়েছিল তাকে। আজও সেই বাড়িটা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৭ সালের জুন মাসের ৩ তারিখে কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি সম্মাননা পেলেন। দুপুরে গোলপার্কের কাছে তের পার্বণ বলে একটা রেস্টুরেন্টে আমরা খেতে গেলাম। এ সময় কি মনে হলো আমি তার সাথে একটা ছবি তুললাম। আমাকে বলে উঠলেন, শালা ছবি তুলছিস কেন, আমি কি মরে যাবো? কিছু দিন পরেই কথাটা যে সত্যি হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।’
রাজ্জাক ছিল আমাদের পাড়ার চকোলেট বয়- চোখের পানি ফেলে এমনটাই বললেন নায়করাজ রাজ্জাকের বাল্যবন্ধু টি দাস ওরফে হিটলার। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হিটলার বলেন, ‘আমরা একই স্কুলে পড়তাম। ছোটবেলা থেকেই নাটক করতাম ওর উদ্যোগে। একটা নাটকের ক্লাব বানিয়েছিল নবঝংকার নাট্য সমিতি নামে। পাড়ার মধ্যে প্যান্ডেল খাটিয়ে টিকিট বিক্রি করে আমরা নাটক করতাম। আমরা ৬ বন্ধু ছিলাম খুব অন্তরঙ্গ। বাকিরা হলো, লালজি, রণেন, পিলু আর প্রদীপ। আমরা বিদ্রোহ নাটক করেছিলাম। পরে দুই মহল নামে একটা নাটক নিয়ে আমরা কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে শো করেছি। সব খরচ ও করতো। আর নাটকের পর যথারীতি পাওনাদাররা ওর বাড়িতে গিয়ে হামলা করতো। একবার হিরো হওয়ার লোভে, ৫৬ সালে পালিয়ে গেলো মুম্বাইতে। আবার ফিরেও এলো। বাড়ির লোক তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলো। লক্ষ্মীর সাথে। ও খুব কষ্ট করেছে। এক ছেলেকে নিয়ে দিনের পর দিন। টালিগঞ্জে অভিনয় করেছিল, তবে সাইড রোলে।’
রাজ্জাকের কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়াটা আজও মেনে নিতে পারেন না বাল্যবন্ধু হিটলার। এদিন তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য ৬৪ দাঙ্গায় ওকে মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে হলো। ওকে রক্ষা করতে পারলাম না। পরে ও যখন কলকাতায় এলো মুক্তিযুদ্ধের পর; আমাকে বললো, দেশ ছেড়ে আমি একটুও দুঃখ পাইনিরে। বরং ভালোই হয়েছে, এটা না হলে আমার ভাগ্যের চাকা হয়তো ঘুরতো না।’
শারীরিক সৌন্দর্যের কারণে রাজ্জাক ছিলেন পাড়ার মেয়েদের হিরো। এমনটা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ও ছিল আমাদের চকোলেট বয়। পাড়ার সব বাড়িতে ওর জন্য ছিল অবারিত দ্বার। আমাদের বাড়ি হিন্দু রক্ষণশীল পরিবার হলেও রাজ্জাক ঠাকুরঘরে ঢুকতে পারতো। শুধু তা-ই নয়, আমার দিদিমা মরে যাওয়ার পর ও কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে গেছিলো।’
নায়করাজ রাজ্জাক। বাংলা চলচ্চিত্রকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এ মানুষটির মৃত্যু হয় ২১ আগস্ট ২০১৭ সালে।
নায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে নায়করাজের যাত্রা জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবি দিয়ে। এতে তার বিপরীতে ছিলেন কোহিনূর আক্তার সুচন্দা। প্রযোজক হিসেবে নায়করাজের যাত্রা হয় ‘রংবাজ’ ছবিটির মাধ্যমে। এটি পরিচালনা করেছিলেন জহিরুল হক। রাজ্জাকের বিপরীতে ছিলেন কবরী। ববিতার সঙ্গে জুটি বেঁধে নায়করাজ প্রথম নির্দেশনায় আসেন ‘অনন্ত প্রেম’ চলচ্চিত্র দিয়ে। এই ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। নায়ক হিসেবে এ অভিনেতার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল শফিকুর রহমান পরিচালিত ‘মালামতি’। এতে তার বিপরীতে ছিলেন নূতন।
এক জীবনে তিনি প্রায় ৩০০টি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র।
১৯৭২ থেকে ৮৯ সাল পর্যন্ত রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে, ‘স্লোগান’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘অতিথি’, ‘কে তুমি’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘পলাতক’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘খেলাঘর’, ‘চোখের জলে’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ভাইবোন’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘সাধু শয়তান’, ‘অনেক প্রেম অনেক জ্বালা’, ‘মায়ার বাঁধন’, ‘গুণ্ডা’, ‘আগুন’, ‘মতিমহল’, ‘অমর প্রেম’, ‘যাদুর বাঁশী’, ‘অগ্নিশিখা’, ‘বন্ধু’, ‘কাপুরুষ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘সখি তুমি কার’, ‘নাগিন’, ‘আনারকলি’, ‘লাইলী মজনু’, ‘লালু ভুলু’, ‘স্বাক্ষর’, ‘দেবর ভাবী’, ‘রাম রহিম জন’, ‘আদরের বোন’, ‘দরবার’, ‘সতীনের সংসার’ প্রভৃতি।