আলম ভাইয়ের স্মরণসভায় আমাকে আসতে হবে, কিছু বলতে হবে- সেটা কখনও ভাবিনি। কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক আলম খানের স্মরণসভায় এসে কথাগুলো বললেন নন্দিত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।
২৪ জুলাই সন্ধ্যায় রাজধানীর শিল্পকলা অ্যাকাডেমির চিত্রশালা অডিটোরিয়ামে এই স্মরণসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যাতে বক্তা হিসেবে সাবিনা ইয়াসমিন ছাড়াও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান, কাজী হাবুল, কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশিদ আলম, শিল্পকলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ও আলম খানের পুত্র সংগীত পরিচালক আরমান খান।
অনুষ্ঠানে এসে স্মৃতিকাতর সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘অনেক স্মৃতি আমাদের। অনেক মজার ও দুঃখের স্মৃতি আমাদের। অসংখ্য গান গেয়েছি আলম ভাইয়ের সুরে। সেই গান তৈরির সময় কতো কথা হতো। সেসব এখন খুব ভাবায় আমাকে। তিনি ব্যতিক্রমী সুরকার ছিলেন। সৃজনশীল সুরকার ছিলেন। আলম ভাইর সুর শুনলেই বোঝা যেতো এটা ওনার সুর। আলম ভাই নতুন অনেক শিল্পীকে সুযোগ দিয়েছেন। তার আত্মা যেন চিরশান্তিতে থাকে সেই প্রার্থনা করি।’
সাবিনা ইয়াসমিনের মতোই আলম খানের সৃষ্টি অনেক কালজয়ী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। স্মৃতি থেকে এই শিল্পী বলেন, “স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যে ক’জন মানুষ বাংলা গানে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন আলম খান তারমধ্যে অন্যতম। শেষ পর্যন্ত প্রায়ই আলম খানের সঙ্গে কথা বলতাম ফোনে। শেষ দেখা আমার আত্মজীবনী প্রকাশের দিন। তিনি অসুস্থ ছিলেন। তবু এসেছিলেন আমাকে ভালোবেসে। তিনি চলে গেছেন, তার সৌরভ যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে থেকে যাবে- এটাই বড় সান্ত্বনা।’
স্মৃতিচারণ শেষে পরিবেশন হয় আলম খানের সুরে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু গান। এগুলো পরিবেশন করেন খুরশিদ আলম, পান্থ কানাই, রন্টি, সম্রাট, স্মরণ প্রমুখ। এর আগে সন্ধ্যা ৭টায় এক মিনিট নীরবতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই স্মরণ অনুষ্ঠানের। পুরো আয়োজনটি করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের অন্যতম সংগীতশিল্পী, গীতিকবি, সুরকার ও সাংবাদিকরা।
গত ৮ জুলাই বেলা ১১টা ৩২ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলম খান। ২০১১ সালে ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে এই শিল্পীর।
আবদুল জব্বার খানের ‘কাঁচ কাটা হীরে’ সিনেমার মাধ্যমে ১৯৭০ সালে চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন আলম খান। তারও আগে ১৯৬৩ সালে রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে ‘তালাশ’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অসংখ্য সিনেমার মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি। ধারাবাহিক সাফল্যের মধ্য দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন একের পর এক জনপ্রিয় গান।
১৯৪৪ সালের ২২ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের বানিয়াগাতি গ্রামে আলম খান জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম খুরশিদ আলম খান। বাবা আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট-এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ও মা জোবেদা খানম গৃহিণী। আলম খানের মা জোবেদা খানম ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারের এক শিল্পীর বংশধর। সিরাজগঞ্জে কয়েক বছর থাকার পর বাবার চাকরির সুবাদে তিনি কলকাতায় চলে যান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাবার সাথে ঢাকায় ফিরে আসেন।
তারপর ঢাকাতেই স্থায়ী এবং সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুলে থাকাকালীন তার গানের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয়। বাবা আফতাব উদ্দিন প্রথমে অনাগ্রহ দেখালেও মায়ের উৎসাহে গানের চর্চা চালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে তার বাবাই তাকে ওস্তাদ ননী চ্যাটার্জির কাছে গানের তালিমের জন্য নিয়ে যান। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে আলম খান মেজো। বাংলাদেশের প্রখ্যাত পপ সংগীত শিল্পী আজম খান ছিলেন তার ছোট ভাই।
আলম খানের সুরকৃত প্রথম জনপ্রিয় গান ছিল স্লোগান ছায়াছবির ‘তবলার তেড়ে কেটে তাক’। এরপর ১৯৭৭ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন তার পরিচালিত সারেং বৌ চলচ্চিত্রের গান নিয়ে কথা বলার সময় তার ১৯৬৯ সালের সুর করা একটি মুখরা শুনালে ছবির পরিচালক তা নিতে আগ্রহী হন।
১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সেই ছবির আবদুল জব্বারের কণ্ঠে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি তার এক অনন্য সৃষ্টি। ১৯৮২ সালে রজনীগন্ধা চলচ্চিত্রে তার সুরারোপিত সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’ এবং সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ও এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’ দর্শকদের মন কাড়ে। এমনি অসংখ্য কালজয়ী গানের এই সুরকার এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন। তার সুর করা গানের সংখ্যা দুই হাজারের ওপরে।
আলম খান ১৯৭৬ সালে হাবিবুননেসা গুলবানুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। গুলবানু একজন গীতিকার। আলম খানের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া ‘তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছো’ গানটির গীতিকার গুলবানু। তাদের দুই ছেলে আরমান খান ও আদনান খান দুজনেই সংগীত পরিচালক এবং একমাত্র মেয়ে আনিকা খান।
আলম খান শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে ১৯৮২ সালে মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর তিনি ‘তিন কন্যা’ (১৯৮৫), ‘সারেন্ডার’ (১৯৮৭), ‘দিনকাল (১৯৯২) এবং ‘বাঘের থাবা’ (১৯৯৯), ‘এবাদত’ (২০০৯) ছবিগুলোতে একই পুরস্কারে ভূষিত হন। শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে ২০০৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ‘কি জাদু করিলা’ ছবির জন্য।