আফজাল হোসেনকে বলা হয় টিভি নাটকের স্বর্ণযুগের প্রধানতম নায়ক। কথাটি তিনি নিজেও স্বীকার করেন, একটু অন্যভাবে। বলেন, ‘এটা আমার সৌভাগ্য টিভি নাটকের স্বর্ণযুগটা পেয়েছি।’ তবে বিশ্লেষকদের অভিমত, আফজাল হোসেন যে মাপের অভিনেতা, ঠিক সে মাপে পরবর্তী সময়ে তাকে পাওয়া যায়নি। কারণ, মাঝে দীর্ঘ বিরতিতে ছিলেন এই অভিনেতা।
তবে আশার কথা, সাম্প্রতিক সময়ে আফজাল হোসেনকে ফের পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত। বিশেষ করে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তিনি রীতিমতো চমকে দিচ্ছেন নানামাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করে। সেই সূত্রে এবার তাকে পাওয়া যাবে দেশ ভাগের সিনেমা ‘যাপিত জীবন’-এ। সরকারি অনুদান নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব। রাজবাড়ী জেলার পেশকার বাড়িতে চলছে টানা শুটিং।
রবিবার (৪ ডিসেম্বর) সেখানেই বাংলা ট্রিবিউন-এর মুখোমুখি হন এই কিংবদন্তি। কথা বলেন নিজের অতীত, বর্তমান ও আগামীর ভাবনা নিয়ে। জানান দেন, এখন অভিনয়ে নিয়মিত হলেও ফের চলে যেতে পারেন নেপথ্যে। যে কথার পরতে পরতে ছিল অভিমান আর আক্ষেপের রেশ। তবে সে বিষয়ে যাবার আগে জেনে নেওয়া যাক তার ‘যাপিত জীবন’র গল্প।
ছবিটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে আফজাল হোসেন বলেন, ‘পরিচালক হাবিবুল ইসলাম হাবিব যখন আমাকে এই পাণ্ডুলিপি পাঠালো, পড়লাম। পড়ে যে বিষয়টা ভালো লাগলো, সেটা হলো ছবিটির গল্প আমাদের অতীত ইতিহাস নিয়ে। আমাদের প্রজন্ম আন্দোলন-সংগ্রাম-লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশটাকে পাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে সরাসরি জানি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি পড়ে বা শুনে জানতে পেরেছি। ৪৭ সালের দেশ ভাগের ঘটনা আরও পেছনের। দেশ ভাগ, দেশ ছেড়ে মানুষের চলে যাওয়া এবং সে দেশটিকে নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা—এমন অনেক ঘটনা। যেগুলো বর্তমান প্রজন্মের জানা উচিত। পেছনের চর্চাটা থাকলে একটা দেশ কেমন করে পেলাম, সেই বোধ বা দেশপ্রেমটা তৈরি হয়। সেজন্যই ভালোলাগাটা।’
সিনেমায় গল্পের পরিণতি প্রসঙ্গে আফজাল হোসেন বলেন, ‘শুটিংয়ে যখন এলাম, প্রত্যেকের মধ্যে ওই ফেলে আসার কষ্টটা দেখতে পেলাম। নতুন একটি দেশে থিতু হওয়ার যে চেষ্টা সেটাও আছে। কিন্তু মানুষের যে দুর্ভাগ্য নানা সংকটের মধ্য দিয়ে, মানুষ যে জায়গাটায় শেষ পর্যন্ত পৌঁছায়, সেটা বেদনারই থাকে। এই গল্পটার ভেতর দিয়ে সেটাই বলার চেষ্টা করছি আমরা। তাই সেই সময়ের চরিত্র হওয়ার চেষ্টা করেছি সর্বোচ্চ।’
আফজাল হোসেন মনে করেন, এ ধরনের গল্পে চ্যালেঞ্জ থাকে। তার ভাষ্যে, ‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে সেই সময়ের চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য, হাঁটা-চলা, গেটআপ-মেকআপ, লোকেশন, কথা বলার ধরন সঠিকভাবে করতে হচ্ছে। কারণ, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেটা যদি দর্শকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না করা যায়, তাহলে আবেদনটা নষ্ট হয়। ফলে কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং। তাই আমরা সবাই মিলে চেষ্টাটা করছি, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও যেন সেই মানুষগুলো হতে পারি। আমরা ঢাকা থেকে অনেক দূরে এই জায়গাটাতে (রাজবাড়ী) এসেছি। জায়গাটার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। আশা করছি দর্শকরা পছন্দ করবেন।’
বললেন, ‘আমার জন্য কিন্তু এটা নতুন অভিজ্ঞতা। আমি অভিনয় হয়তো ৭৫ সাল থেকে করি। কিন্তু এটা ঠিক, এই প্রজন্মের যারা প্রতিভাবান শিল্পী আছেন, প্রত্যেকেরে সঙ্গে যে আমার পরিচয় আছে বা কাজ করেছি তা নয়। আমি ইদানীং কাজ করা শুরু করেছি নিয়মিত। ফলে এমন সুযোগ যখন আসে, সেটি উপভোগ করার চেষ্টা করি। আমার ভালো লাগে অনেক পরের প্রজন্ম কাজগুলো কীভাবে করছে কীভাবে দেখছে, সেটা জানতে পারলে। আমি বিশ্বাস করি, যেকোনও মানুষের প্রতিদিন শিখবার অনেক কিছু আছে। এতে আমি আরও পরিণত হচ্ছি।’
৪৭ বছরের অভিনয় জীবন আফজাল হোসেনের। যদিও মাঝের দীর্ঘ সময় তিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা পরিচালনা ও নির্মাণে। সেসব ছাপিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অভিনয় করছেন নিয়মিত। তাহলে কেন মাঝে লম্বা বিরতিতে গেলেন; এখনই বা কেন নিয়মিত হলেন। এমন প্রশ্নের জবাবে আফজাল হোসেন হৃদয়ের আগল খুলে দিলেন। করলেন অভিমান আর আনন্দ বয়ান।
এমন ভাষ্যে কিংবদন্তি আফজাল হোসেন বলতে চাইলেন, চরিত্রনির্ভর কনটেন্ট তৈরির যে চর্চাটা শুরু হয়েছে ওটিটি থেকে সিনেমায়; সেটা যেন অব্যাহত থাকে। নয়তো এভাবেই অভিমান জন্মাবে জনে জনে, নেপথ্যে রয়ে যাবে অভিমানী ঢাকাই অমিতাভরা।