প্রয়াণ দিনে স্মরণ

অস্ত্র হাতে বীর, গানে তিনি গুরু

রাজধানীর মূল জৌলুস তখন পুরান ঢাকায়। সেই পুরান ঢাকার আজিমপুরে ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। অবশ্য ছয় বছর বয়সে চলে যেতে হয় কমলাপুরে। ফলে সেখানেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা। পারিবারিক আবহে গানের চর্চাটা ছিল। তাই তিনিও টুকটাক গান করতেন। কিন্তু তখনও সংগীত নিয়ে ভাবেননি কিংবা ভাবার বয়সও ছিল না। তবে গণসংগীত তাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করতো। তাই স্কুল জীবনেই প্রতিবাদের সুর কণ্ঠে তুলে নেন।
 
দেশে তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের অঙ্কুরোদগম হচ্ছে ধীরে ধীরে। পাকিস্তানি শাসকেরা যে দেশের মানুষকে ঠকাচ্ছে, নানা দিক থেকে বঞ্চিত করছে, এসব বুঝতে পারেন তিনি। সেই সূত্রেই মনের ভেতর বিপ্লবী সত্তার জন্ম হয়। গণসংগীতের দল ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর কথা শুনতে পান। এরপর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গাইতে থাকেন গণসংগীত। প্রথমে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, অতঃপর ঢাকার আশপাশেও প্রতিবাদ আর অধিকারের সুর নিয়ে ছুটে যান।
 
তখন তিনি একুশের টগবগে তরুণ। নানা ধাপ পেরিয়ে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীনের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। অদম্য সাহস বুকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, যুদ্ধে যাবেন। ভয়ে ভয়ে বাবাকে কথাটা জানালেন। বাবা তাকে আদেশ দেন, ‘যুদ্ধে যাবি যা, কিন্তু দেশ স্বাধীন করে তবে ঘরে ফিরবি’। বাবার সেই কথা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন তিনি। ট্রেনিং নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। সেকশন কমান্ডার হয়ে সম্মুখ যুদ্ধে যেমন ছিলেন, তেমনি গেরিলা যুদ্ধেও বীরের ভূমিকা পালন করেছেন। এর ফাঁকে ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গেয়ে সহযোদ্ধা ও মানুষকে উৎসাহ দেয়ার কাজটিও বাদ রাখেননি। 

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। চারদিকে বয়ে এলো স্বস্তির বাতাস। তখন তার মনে প্রশ্ন এলো, এবার কী করবেন? ভেবেচিন্তে দেখলেন, গানটাই তার আয়ত্তে আছে। এদিকেই মনোযোগ দেওয়া যাক। 
গানের চর্চা থাকায় আন্তর্জাতিক ব্যান্ড মিউজিকের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে ছোটবেলাতেই। ‘বিটলস’, ‘দ্য শ্যাডোজ’ কিংবা ‘রোলিং স্টোন’র গান শুনে পশ্চিমা মিউজিকে আগ্রহ জন্মায়। তবে নিজেকে ঠিক পশ্চিমাদের অনুকরণ করলেন না। সেই আবহে একটা দেশী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সরল কথা-সুরে বাঁধতে শুরু করলেন গান। পপ ঘরানার সেসব গান তখন এই তল্লাটে একেবারে অচেনা। তিনি পথিকৃৎ হয়ে চেনালেন, জনপ্রিয় করে তুললেন। এ জন্য সবাই তাকে ‘পপগুরু’ বলে অভিহিত করেন। 

১৯৭২ সালে বন্ধুদের নিয়ে ‘উচ্চারণ’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেন তিনি। একই বছর বিটিভিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান। সেখানে ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি গেয়ে দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনি সৃষ্টি করলেন কালজয়ী গান ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’। যা এখনও মানুষের মুখে মুখে। 

আজম খান (২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০- ০৫ জুন ২০১১)পরবর্তী সময়ে আরও বহু গানে শ্রোতাদের মনে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ‘আমি যারে চাই রে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘একসিডেন্ট’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘পাপড়ি’, ‘বাধা দিও না’, ‘যে মেয়ে চোখে দেখে না’ ইত্যাদি। 

শুধু গান নয়, তিনি অভিনয় ও মডেলিংও করেছেন। ১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ নামে হিরামনের একটি নাটকে কালা বাউলের চরিত্রে এবং ২০০৩ সালে শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এছাড়া কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবেও তাকে দেখা গেছে।
 
সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক দেওয়া হয়। যদিও এর ৭ বছর আগেই, ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। আজ সোমবার (৫ জুন) তার প্রয়াণের একযুগ। 

যার আসল নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। সংগীতের চিরোজ্জ্বল ও রঙিন ইতিহাস সৃষ্টি করে সাদামাটা সরল এক জীবন কাটিয়ে যাওয়া এই কিংবদন্তির প্রতি শ্রদ্ধা। গানপ্রিয় মানুষেরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, কার বন্দনা চলছে। কারণ ‘পপগুরু’ উপাধি এই দেশে কেবল একজনের নামের আগেই শোভা পায়। তবু বলার জন্য বলা, তিনি আজম খান।