ইরানি অভিনেত্রী-নির্মাতা জার আমির ইব্রাহিমি এবং ইসরায়েলি নির্মাতা গাই নাটিভ যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন ‘তাতামি’। তেহরানের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ ঠেকাতে এই চলচ্চিত্রের দৃশ্যধারণ করতে হয়েছে গোপনে। এবারই প্রথম ইরানি ও ইসরায়েলি দুই নির্মাতা একসঙ্গে কাজ করলেন। এদিক দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন তারা। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ৮০তম আসরে হরাইজন্স শাখায় এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর দর্শকরা এটি দেখার পর পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন।
বিশ্ব জুডো চ্যাম্পিয়নশিপকে কেন্দ্র করে থ্রিলার ছবিটির গল্প। টুর্নামেন্টে ইরানের জুডোকা চ্যাম্পিয়ন লেইলার অংশগ্রহণ করার একদিনের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে এতে। তার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ফার্সিভাষি আমেরিকান অভিনেত্রী আরিয়েন ম্যান্ডি। ইসরায়েলি প্রতিযোগীর সঙ্গে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে ইনজুরির মিথ্যে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেওয়া হয় মেয়েটিকে!
ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিতে ছবিটির চিত্রায়ন হয়েছে। তেহরান থেকে সেখানে যেতে লাগে দুই ঘণ্টা। তেল আবিব থেকে যেতেও লাগে দুই ঘণ্টা। ইরানিরা অনায়াসে এই দেশে যাতায়াত করতে পারেন। জার আমির ইব্রাহিমি এবং গাই নাটিভ জানতেন– সেখানে অনেক ইরানি আছে। তাই সবকিছুতে গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন এই দুই নির্মাতা। এজন্য তারা আলাদা হোটেলে থাকতেন ও ইংরেজিতে কথা বলতেন। সেই সঙ্গে সবসময় চোখ-কান খোলা রাখতেন এজন্য যে, কেউ যেন ঘুণাক্ষরে বুঝতে না পারে– রাজনীতির আবহে এমন একটি সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে। কারণ একজন মুসলিম নারী ও একজন ইহুদি পুরুষের একসঙ্গে কাজ করার ঘটনা দৃশ্যধারণ চলাকালে জানাজানি হলে ইরান কিংবা ইসরায়েল দুই দেশের সরকার মেনে নিতো না।
গাই নাটিভ বলেন, ‘আমরা গোপনে ছবিটি পরিচালনা করেছি। কারণ আমরা জানতাম, এটি বিপজ্জনক কাজ।’
পরিচালনার পাশাপাশি ছবিটিতে ইরানি জুডোকার আতঙ্কিত প্রশিক্ষক মরিয়ম চরিত্রে অভিনয় করেছেন জার আমির ইব্রাহিমি। গত বছর ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘হলি স্পাইডার’ সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের সুবাদে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন তিনি। ২০০৮ সালে নিজের একটি ব্যক্তিগত ভিডিও ফাঁস হওয়ার পর কারাদণ্ড ও বেত্রাঘাতের ভয়ে ইরান থেকে পালিয়ে যান এই তারকা। এখন তিনি ফ্রান্সেরও নাগরিক।
গাই নাটিভের কাছ থেকে ছবিটি যৌথভাবে নির্মাণের প্রস্তাব পেয়ে সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে ভাবতে সময় নিয়েছিলেন জার আমির ইব্রাহিমি। তার কথায়, ‘ইরান সরকারের ব্যাপারে যা বুঝেছি তা হলো– যতক্ষণ আপনি ভয় পাচ্ছেন তারা আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে, হত্যা করতে পারে, চারপাশে সমস্যা তৈরি করতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ ভয় পাবেন না, ততক্ষণ সবকিছুই ভালো থাকবে।’
ইরানে বেড়ে ওঠা শিশুদের স্কুলে ইসরায়েলকে শত্রু হিসেবে ভয় দেখানো হয়। একইভাবে ইরানকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে ইসরায়েল।
গত ফেব্রুয়ারিতে ৭৩তম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতার বাইরে গাই নাটিভের আগের ছবি ‘গোল্ডা’র উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়। এটি হলো ইসরায়েলের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের বায়োপিক। তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন হেলেন মিরেন। ২০১৯ সালে গাই নাটিভের ‘স্কিন’ অস্কারে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে।
২০০০ সালে ‘খাত’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন জার আমির ইব্রাহিমি। ‘তাতামি’ তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র। ৪২ বছর বয়সী এই তারকা এখন ‘অনার অব পার্সিয়া’ নামের একটি চলচ্চিত্র এককভাবে পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এছাড়া লালগালিচায় দেখা গেছে ইরানের জাতীয় পতাকা, ইরানি নারীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান সম্পর্কিত ব্যানার-ফেস্টুন, হিজাব না পরার অপরাধে পুলিশি হেফাজতে নিহত মাহসা আমিনির ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড। ইতালিয়ান ভাষায় নারী জীবনের স্বাধীনতা সপক্ষে এবং ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিবিরোধী ব্যানার হাতে সমাবেশে ছিলেন ভেনিস উৎসবের পরিচালক আলবের্তো বারবেরা। উৎসবের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ইতালিয়ান অভিনেত্রী ক্যাতেরিনা মুরিনোর হাতেও দেখা গেছে প্ল্যাকার্ড। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর উৎসবটির পর্দা নামবে।