থাইল্যান্ড যাওয়ার সময় রবিবার (১৮ মে) নায়িকা-গায়িকা নুসরাত ফারিয়াকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথমে আটক পরে গ্রেফতার করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। জানা গেছে, নায়িকার বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় করা একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ওই মামলায় তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আসামি করা হয়। আজ (১৯ মে) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এমন বিস্ময়কর ঘটনায় গতকাল থেকে ফুঁসে উঠেছে সোশ্যাল হ্যান্ডেল। লাল-নীল নির্বিশেষে সকল পক্ষের শিল্পী, দর্শক ও সমালোচকরা বিস্মিত সরকারের এমন কাণ্ডে। তারচেয়েও বিস্ময়কর, জুলাই বিপ্লবের পুরোটা সময় নুসরাত ফারিয়া ছিলেন দেশের বাইরে। অনেকেই মনে করছেন, মামলা নয়, ফারিয়ার অপরাধ ‘মুজিব’ সিনেমায় অভিনয়।
এমন পরিস্থিতিতে সোশ্যাল হ্যান্ডেলে অনেকেই আঙুল তুলছেন ‘মুজিব’-অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার প্রতি। কারণ তিনি নিরাপদেই আছেন তাই নয়, তার স্বামী নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী হয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা! বিপরীতে নিগ্রহের শিকার হয়ে চলেছেন ‘মুজিব’ সিনেমার অন্য শিল্পীরা। যার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যাচ্ছে অরাজনৈতিক নুসরাত ফারিয়ার প্রতিও।
আশার কথা, বেশিরভাগ মানুষের এমন সমালোচনার বিপরীতে নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার বেলা ১১টা ১২ মিনিটে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তুলে ধরেছেন এই বিষয়ে নিজের অবস্থান। যা অনেকটাই স্বস্তির বার্তা বহন করছে মিডিয়ায়।
ফারুকী লিখেছেন, ‘আমি সাধারণত চেষ্টা করি, আমার মন্ত্রণালয়ের কাজের বাইরে কথা না বলতে। কিন্তু আমার তো একটা পরিচয় আছে, আমি এই ইন্ডাস্ট্রিরই মানুষ ছিলাম এবং দুই দিন পর সেখানেই ফিরে যাবো। নুসরাত ফারিয়ার গ্রেফতার বিব্রতকর একটা ঘটনা হয়ে থাকলো আমাদের জন্য। আমাদের সরকারের কাজ জুলাইয়ের প্রকৃত অপরাধীদের বিচার করা। ঢালাও মামলার ক্ষেত্রে আমাদের পরিষ্কার অবস্থান প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। এবং সেই নীতিই অনুসরণ করা হচ্ছিল।’
মামলা ও গ্রেফতার প্রসঙ্গে বলেন, ‘ফারিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলাতো অনেকদিন ধরেই ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে গ্রেফতারের কোনও উদ্যোগ নেয়ার বিষয় আমার নজরে আসেনি। কিন্তু এয়ারপোর্টে যাওয়ার পরেই এই ঘটনাটা ঘটে। আওয়ামী লীগের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশ গমনকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের পর ওভার নারভাসনেস থেকেই হয়তোবা এইসব ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।’
রাজনীতিক আন্দালিব পার্থর স্ত্রীর প্রসঙ্গ টেনে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘কয়দিন আগে ব্যারিস্টার আন্দালিব পার্থের স্ত্রীর সঙ্গেও এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। এইসব ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। আমি বিশ্বাস করি ফারিয়া আইনি প্রতিকার পাবে। এবং এই ধরনের ঢালাও মামলাকে আমরা আরও সংবেদনশীলভাবে হ্যান্ডেল করতে পারবো—এই আশা। মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রধান কাজ জুলাইয়ের প্রকৃত অপরাধীদের বিচার করা।’
এদিকে ফারুকীর অন্যতম শিষ্য, বরাবরই বিপ্লবী ভূমিকায় থাকা আশফাক নিপুন নুসরাত ফারিয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে লেখেন, ‘এভাবেই দিনে দিনে প্রকৃত খুনি এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দুর্বল করতে অন্যদের সফট টার্গেট করা হয়ে আসছিল এবং করা হচ্ছে। এটাকে আর যাই হোক, সংস্কার বলে না সরকার। হত্যাচেষ্টার যে মামলা করা হলো এবং যে হত্যার সময় তিনি দেশেই ছিলেন না, সেই অভিনেতা নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেফতার এবং কারাগারে প্রেরণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ইঙ্গিতই দেয়।’
জুলাই বিপ্লবের অন্যতম এই যোদ্ধা বলেন, ‘আমরা জুলাই গণহত্যার সুষ্ঠু বিচার চাইছিলাম। কোনোরকম প্রহসন চাই নাই, এখনো চাই না। চিহ্নিত অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়া/পালাতে দেয়া এবং ঢালাও গায়েবি মামলাবাজির নাটক বন্ধ করেন।’
ফারুকীর আরেক শিষ্য নির্মাতা-অভিনেতা শরাফ আহমেদ জীবন আরও একধাপ বিস্তারিত লিখলেন। বললেন, ‘একটু আগে একটা চ্যানেলের লাইভে দেখলাম নুসরাত ফারিয়াকে আদালতে নেয়া হচ্ছে! কোন এক অদ্ভুত কারণে মনটা খারাপ হয়ে গেলো! বুঝার চেষ্টা করলাম। নুসরাত ফারিয়ার অপরাধটা কী?’
এরপর তিনি নুসরাত ফারিয়ার দুটি অপরাধ বের করেন। একটি, ‘মুজিব’ সিনেমায় অভিনয় করা! অন্যটি, জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার সাথে ফারিয়াও হত্যা মামলার আসামী!
‘চক্কর’ নির্মাতা তিরস্কারের সুরে বলেন, ‘‘কী ভয়ংকর হাস্যকর! নুসরাত ফারিয়া একজন শিল্পী! সে ‘মুজিব’ সিনেমায় অভিনয় করেছে! আরও অনেক শিল্পীই অভিনয় করেছে! অনেক শিল্পী অডিশন দিয়েছে। বাদ পড়েছে। অনেকে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল! তাহলে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হবে?’’
এরপর বাস্তবতার কথা তুলে ধরে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’খ্যাত অভিনেতা, ‘আমি, ভাবছি আমার কথা! নুসরাত ফারিয়ার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম! আমাকে ডাকলে আমিও যেতাম। কারণ দুইটা- ১. আমি শিল্পী। শিল্পীর কাজ হলো যে কোনও শিল্প মাধ্যমে নিজেকে যুক্ত করা। ২. ক্ষমতা! এইটার ব্যাখ্যা দরকার নাই! এখন আসি আসল কথায়, বর্তমান সরকার কোনও শিল্পীকে সরকারি কোনও কাজে ডাকলো এবং পরের সরকার এসে গ্রেফতার করলো! হইতেই পারে। তাইলে শিল্পীদের কী করা উচিত! দেশের বা রাষ্ট্রীয় কোনও কাজে অংশগ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখা!’
শেষে আরও লেখেন, ‘‘এমন অনেক শিল্পী আছে, যারা অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। আমার ধারণা, সাধারণ মানুষ এতে খুশি হয়েছে। কারণ এরা আসলে প্রকৃতি শিল্পী ছিল না! এরা ছিল শিল্পীর মুখোশধারী ক্ষমতালোভী! নুসরাত ফারিয়াকে আমার অন্তত এদের দলের মনে হয়নি! শেষমেশ, আমার ‘চক্কর’ সিনেমার একটা সংলাপ দিয়ে শেষ করি, ‘সব আলামত সত্যি হয় না। কিছু আলামত মূল কাজের ফোকাস নষ্ট কইরা দেয়।’ প্রিয় সরকার, আপনাদের ফোকাস নষ্ট কইরেন না প্লিজ!’’