৭৬তম কান উৎসব

আলোচনায় যখন ‘কিলারস’, তারা তখন কানের ‘ফ্লাওয়ার’

সব ছাপিয়ে গেল দুই দিন ধরে কানজুড়ে চলছে ‌‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’-এর প্রশংসা। লালগালিচা, প্রিমিয়ার এবং সংবাদ সম্মেলন পেরিয়ে সাগরপাড়ের শহরটির মূল সড়কে মিলেছে সেই প্রতিচ্ছবি।

সেদিকে যাওয়ার আগে বলা দরকার, ছবিটি পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী নির্মাতা মার্টিন স্করসেসি। এতে অন্যতম চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেক অস্কারজয়ী লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও। তাদের নতুন কাজটিকে ঘিরে কানসৈকত হয়ে এখন প্রায় গোটা বিশ্বেই চলছে প্রশংসার উচ্ছ্বাস। কারণ, এটি নির্মিত হয়েছে ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় ঘটে যাওয়া একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। যেখানে মূলত উপজাতি-আদিবাসী তথা ইন্ডিজেনাস পিপলদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে।

‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’ ৭৬তম কান উৎসবে প্রতিযোগিতার বাইরে থাকলেও গত সাত দিন প্রদর্শিত ছবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছে (পুরো থিয়েটারের দর্শকরা দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে অভিবাদন জানানো)। ছবিটি প্রদর্শনের পর মার্টিন, লিওনার্দো, নিরো ও লিলিরা টানা ৯ মিনিটের স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছেন। কানসূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত এত দীর্ঘ অভিবাদন আর কোনও সিনেমার কলাকুশলীরা পাননি।

কান উৎসবে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে ঘিরে উন্মাদনা ছিল এমন (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

উৎসবের পঞ্চম দিন একই উচ্ছ্বাস মিলেছে ‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’ টিমের লালগালিচা মাড়ানোর সময়। মজার ব্যাপার হলো, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও বরাবরই কানের জন্য আকর্ষণীয়। তবে এবার তাকেও ছাপিয়ে গেছে ছবিটির গল্প।

২০১৭ সালে প্রকাশিত আমেরিকান কথাসাহিত্যিক ডেভিড গ্রানের জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন: দ্য ওসেজ মার্ডারস অ্যান্ড দ্য বার্থ অব দ্য এফবিআই’ অবলম্বনে সাজানো হয়েছে তিন ঘণ্টা ২৬ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটি। ১৯২০ শতকের আমেরিকান রাজ্য ওকলাহোমায় তেল আবিষ্কারের পর রহস্যজনকভাবে ওসেজ উপজাতির একের পর এক সদস্যের নৃশংসভাবে খুন হওয়াকে কেন্দ্র করে এর গল্প। যেমনটা ঘটেছিল মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে, যারা বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে।

বিভিন্ন সময় এমন জাতিগত বৈষম্য বা বিদ্বেষ যে আদিম ও বৈশ্বিক, সেটি যেন মনে করিয়ে দিলো মার্টিন স্করসেসির ‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’। সেজন্যই কানের পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবন যখন ছবিটির গল্পে সরগরম, তখন শহরটির রাস্তায় দেখা মিললো বর্ণিল পোশাক পরা কিছু মানুষকে। যেন ’ফ্লাওয়ার’ (ফুল) হয়ে ঘুরছেন!

কান শহরে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার আদিবাসীরা (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

উৎসবের পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিন কানের পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের সামনের সড়কে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজন ছেলেমেয়ে। হাজার মানুষের ভিড়ে যাদের আলাদা করা যায়। তাদের সঙ্গে আলাপ করে ঢাকা থেকে উড়ে আসা বাংলা ট্রিবিউন প্রতিনিধি। জানা যায়, রাস্তায় দৃষ্টিনন্দন পোশাকে জোটবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো এসেছেন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তারা দেশ দুটির আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করতেই এখানে এসেছেন।

অতিথিরা বলছেন, গোটা বিশ্বের ইন্ডিজেনাস পিপলদের (আদিবাসি বা উপজাতি) জন্য তাদের এই পথসভা। তারা বলতে চাইলেন, ‘যেকোনও রাষ্ট্রে আদিবাসীরা তখন থেকে এখনও অবহেলিত ও নির্যাতিত। তাদের সম্মান দেখানো ও রক্ষা করা সবার কর্তব্য।’

কান উৎসবে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও-মার্টিন স্করসেসি

বিষয়টি এমনও নয় যে, মার্টিন স্করসেসির ‘কিলার অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’ ছবির প্রচারণায় নেমেছেন এসব মানুষ। তবে কোথাও যেন যোগসূত্র রয়েছে দুটো পক্ষের মধ্যে। সেটি এমন হতে পারে, ‘আদিবাসী’রা বিশ্বজুড়েই এখন সংখ্যালঘু এবং হেরে যাওয়া জাতিতে পরিণত হয়েছে। সেটা যেমন সত্যি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, তেমনই সত্যি মিয়ানমার কিংবা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। মূলত বৈশ্বিক বিষয়টিকে মাথায় রেখে আমেরিকা-কানাডা থেকে উড়ে এসেছেন এই তরুণ-তরুণীরা। সবমিলিয়ে এবারের উৎসবের ট্যাগলাইন যেন পরিণত হলো, ‘লেটস স্ট্যান্ড ফর ইন্ডিজেনাস পিপলস!’

পালে ভবনের সামনের সড়কে আনন্দ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করা হলো, হোয়াট অ্যাবাউট ইউক্রেন? প্রশ্নটি শুনেই সমস্বরে তারা চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘উই লাভ ইউক্রেন’। সেই সঙ্গে জানান, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার আদিবাসী।

সংবাদ সম্মেলনে (বাঁ থেকে) সঞ্চালক দিদিয়ের আলুশ, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, লিলি গ্ল্যাডস্টোন, মার্টিন স্করসেসি ও রবার্ট ডি নিরো (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

এদিকে ‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’ গল্পের প্রয়োজনে ওসেজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন নির্মাতা মার্টিন স্করসেসি। নির্মাণের পেছনে তাদের গুরুত্বের কথা জানিয়ে ৮০ বছর বয়সী এই আমেরিকান নির্মাতা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বইটি আমার কাছে দেওয়ার পর বলেছিলাম, আমরা যদি আদিবাসী জাতির কাছাকাছি কোথাও যাই তাহলে তাদের খুব সম্মান করতে হবে। সেটাই করেছি আমরা।’

সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন ওসেজ নেশন প্রধান জিওফ্রে স্ট্যান্ডিং বিয়ার। তিনি ছবিটিতে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কথায়, ‘আমাদের সম্প্রদায়কে অনেক ভুগতে হয়েছে। আজ অবধি সেসব প্রভাব আমাদের ওপর রয়েছে। তবে ওসেজ নেশনের পক্ষ থেকে বলতে পারি, মার্টিন ও তার দল বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে আমাদের। আমরা জানি, বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না।’