ম্যাক্রোঁর জয় কি উগ্র ডানপন্থার উত্থান রুখতে পারবে?

নির্বাচনের পরে ফরাসি জনতার প্রতিক্রিয়াবিশ্বব্যাপী উত্থান ঘটছে সংরক্ষণশীল অর্থনীতি আর উগ্র জাতীয়তাবাদের। ব্রিটেন বেরিয়ে যাচ্ছে ইইউ থেকে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্যেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মধ্যপন্থী ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জয় পেয়েছেন। তবে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের খোলসে ফ্রান্সে যে উগ্র-ডানপন্থার উত্থান ঘটছে, ম্যাক্রোঁর বিজয় তা রুখতে পারবে কিনা, সেই প্রশ্ন মীমাংসিত নয়।

রবিবার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ম্যাক্রোঁ পেয়েছেন ৬৬.৬ শতাংশ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী উগ্র-ডানপন্থী মেরিন লে পেন পেয়েছেন ৩৩.৯৪ শতাংশ ভোট। মূলধারার দুই পার্টি – ডানপন্থী রিপাবলিকান ও বামপন্থী সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার ফলে ফ্রান্সের রাজনীতিতে উগ্র-ডানপন্থার উত্থান ঘটছে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনে পরাজিত হলেও লে পেন প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের ভোট পেয়েছেন। যা ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এফএন) সবচেয়ে ভালো ফলাফল। গত নির্বাচনে লে পেন পেয়েছিলেন ১৮ শতাংশ ভোট।

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এফএন ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী দল। নির্বাচনি প্রচারণায় লে পেন বর্ণবাদী, ইহুদি বিদ্বেষী, মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য তুলে ধরেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে দলের এ প্রতিচ্ছবি কিছুটা বদলের চেষ্টা করেছেন লে পেন। তবে এর ফলে যে তাদের উগ্রপন্থায় খুব বেশি পরিবর্তন এসেছে, তাও নয়।

জ্যঁ জুরেস ফাউন্ডেশনের অবজারভেটরি অব র‍্যাডিক্যাল পলিটিকসের পরিচালক জ্যঁ-ইভ কামু বলেন, ‘নির্বাচনে বড় হারের কারণে এফএন হারিয়ে যাচ্ছে না। আমাদের এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, আগামী কয়েক মাসে শ্রমবাজার খুব ভালো অবস্থায় পৌঁছে যাবে। এটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই যে, সামনের বছরগুলোতে বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব বন্ধ হয়ে যাবে। আর যদি এ অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ২০২২ সালের নির্বাচনে লে পেনের এফএনের উত্থান দেখা যেতে পারে।’ 

ছয় বছর আগে লে পেন এফএনের নেতৃত্বে আসার পর দলটির জনসমর্থন ব্যাপকহারে বেড়েছে। স্থানীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণ বেড়েছে দলটির। লে পেন দলের দায়িত্বে আসার পর তিনি মূলধারার দলগুলোর মতোই রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন। তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও জনপ্রিয়তাবাদী প্রচারণাকেও উসকে দিতে সক্ষম হন। তিনি নিজেকে ‘জনগণের প্রার্থী’ বলে প্রচারণা চালান। সেই সঙ্গে অভিবাসন, শরণার্থী ও মুসলিম বিদ্বেষ, ইইউ, ইউরো, বিশ্বায়ন, বিদেশি শ্রমিক ও কর ব্যবস্থাকে সামনে রেখে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তাবাদী, উগ্র-জাতীয়তাবাদী প্রচারণা চালান। দলটি সম্প্রতি অভিবাসনবিরোধী ও ইসলাম বিদ্বেষী উসকানির প্রচারণা এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, ডানপন্থী, মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যেও এর প্রসার দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে জ্যঁ-ইভ কামু বলেন, ‘পার্লামেন্টে তাদের মাত্র দু’টি আসন রয়েছে, এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লে পেন জিততে না পারলেও এখন আমরা বুঝতে পারব, মূলধারার ডানপন্থার ভেতর এফএন তার চিন্তাগুলো ঢুকিয়ে দিতে কতোটা সফল হয়েছে।’

নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি নিজেকে সহনশীল হিসেবে উল্লেখ করলেও সোমবার নির্বাচনের আগে শেষ বিতর্কে তিনি অভিবাসন ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে খুবই আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করেন। লে পেন প্রথম পর্বে দ্বিতীয় স্থানে থেকে চূড়ান্ত পর্বে নির্বাচনের আগে দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে এসে বলেছিলেন, তিনি পুরো জনগণের প্রেসিডেন্ট হতে চান।

এখন এফএনের প্রধান কাজ হলো পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রাখা। ৫৭৭ আসনের ওই পার্লামেন্টে তাদের মাত্র দু’টি আসন রয়েছে। এবার তারা ১৫টি আসনে জয় প্রত্যাশা করছে। আর তা দলটির উল্লেখযোগ্য উত্থান বলেই বিবেচিত হতে পারে। তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লে পেন অংশ নেবেন কিনা তা এখনও নিশ্চিত করেননি।

২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত প্রথম পর্বের নির্বাচনে মধ্যমন্থী ম্যাক্রোঁ পেয়েছেন ২৩.৭৫ শতাংশ ভোট। অপরদিকে, লে পেন পেয়েছেন ২১.৫৩ শতাংশ। ওই নির্বাচনে দেখা যায়, শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এ দলটি সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। জনসেবা খাতে পুলিশদের মধ্যে তাদের বিপুল সমর্থন রয়েছে। ৩৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে এ পার্টির প্রভাব বেড়েছে বলেও জানা গেছে।

নির্বাচনে জয়ের পর বিজয় ভাষণে বিভক্তির বিপরীতে ঐক্যের প্রশ্নে ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘আমি আপনাদের ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কার কথা শুনেছি। যেসব শক্তি ফ্রান্সকে বিভক্ত করে পদানত করতে চায়, আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব। আমি জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করবো। ইউরোপের ঐক্য নিশ্চিত করবো। পুরো বিশ্ব আজ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’

/বিএ/