বাংলাদেশের বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের প্রতি উদাসীন পশ্চিমবঙ্গ

বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী (ফাইল ছবি)

নাগরিকতার সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিনিময় হয়েছিল ছিটমহলগুলো। তবে ছিটমহল বিনিময়ের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের যে নাগরিকেরা উন্নত জীবনের আশায় ভারতে গেছেন তারা এখন নিরাশা আর হাতাশার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। মৌলিক অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না তাদের। এতে অশান্ত আর উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন তারা, নেমেছেন আন্দোলনেও। তাদের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপাত উদাসীনতা এবং পুরোদস্তুর অক্ষমতার কারণে তাদের ভোগান্তি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

এসব মানুষ এতোটাই মোহভঙ্গ হয়েছেন যে তারা বাংলাদেশে ফেরার কথাও ভাবছেন। স্থানীয় সংবাদকর্মীদের কাছে এমন আকাঙ্ক্ষার কথাই জানিয়েছেন তারা। বলেছেন, মেখলিগঞ্জ প্রশাসন যদি এভাবে তাদের ন্যুনতম মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়কে গুরুত্ব না দেয় তবে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসবেন।

বাংলাদেশের সাবেক বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে তিন হাজার কোটি রুপিরও বেশি বরাদ্দ দিয়েছে বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। ৪৫টি পরিবারের ২০৫ জন সদস্যকে পুনর্বাসিত করার কথা।

২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে থাকা বাসিন্দাদের কুচবিহারে অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়। এসব বাসিন্দাদের পানিশালা এলাকায় পুনর্বাসিত করার ঘোষণা দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অথচ ওই এলাকাটি একটি স্থানীয় নদীর পাশে অবস্থিত এবং মাটিক্ষয় ও বন্যার ঝুঁকিতে থাকে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া বাসিন্দারা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং পানিশালায় যেতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে। এমনই একজন সুচিত্রা বর্মণ। দুই মাসের একটি সন্তান রয়েছে তার। সুচিত্রাকে উদ্ধৃত করে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, তিনি অভিযোগ করেছেন অস্থায়ী আবাসনে থাকার পরও তাদেরকে পানি ও বিদ্যুৎ সংকটে পড়তে হয়। অন্য মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন তারা। ভারতে যাওয়া বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের দাবি, তারা বাংলাদেশে ভালো ছিলেন।   

মেখলিগঞ্জ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, তারা সাবেক ছিটমহল বাসিন্দাদের দুর্দশা দূর করতে সাধ্য মতো চেষ্টা করছেন।

কুচবিহার ভিত্তিক সাংবাদিক পল্লব রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অঞ্চলটির স্থানীয় এক রিয়েল এস্টেট পরিচালনাকারীদের একটি অংশ ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনপুষ্ট। এরা এখন কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত ৩ হাজার কোটি রুপির দিকে নজর দিচ্ছে।

নতুন নাগরিকদের কাছে যেন সবচেয়ে সুলভ প্লটগুলো না যায় তা নিশ্চিতের চেষ্টা করছেন তারা। পানিশালা এলাকার সমস্যা সম্পর্কে জানার পরও লোকজনকে সেখানে পনুর্বাসিত করার উদ্যোগের পেছনে একেই বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। নগরের সুবিধাবঞ্চিত দুর্গম ও নিষ্ফলা এলাকাটি অনেক মানুষের জীবন যাপনের জন্য চরম চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।

কলকাতাভিত্তিক তৃণমূল কংগ্রেস সূত্র দৃঢ়তার সঙ্গে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ওই সূত্রের দাবি, খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ই বলেছেন এসব কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করা হবে না।

অবশ্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। গত সপ্তাহে নারী-পুরুষ-শিশুসহ বিলুপ্ত ছিটমহলের শতাধিক বাসিন্দা মেখলিগঞ্জের ব্লক ডিভিশন অফিসের সামনে অনির্দিষ্টকালের আন্দোলন শুরু করেন। সংবাদকর্মীদের কাছে তারা অভিযোগ করেন, বার বার অনুরোধের পরও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তারা সাড়া পাননি। উল্টো কোনও কোনও স্থানীয় তাদেরকে আন্দোলন বন্ধ না করলে অবিলম্বে গ্রেফতার হতে হবে বলে হুমকি দেন। তবে অদম্য বিক্ষোভকারীরা বলছেন, গ্রেফতার হওয়ার ভয় তাদের নেই, প্রয়োজনে বাংলাদেশে ফিরতে হলেও তারা রাজি।

বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ পুলিশ এক জায়গায় তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করেছে। যারা অসুস্থ হয়ে পড়েন তাদেরকে ন্যুনতম চিকিৎসাটুকুও দেওয়া হয়নি। সব মিলে ওই লাঠিচার্জে ১৮ জন আহত হয়। এর মধ্যে ৮ জন নারীও আছেন।

বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে এগিয়ে আসা নেতারা ফরওয়ার্ড ব্লক এবং সিপিআই(এম) এর সদস্য। আর এ দুটি দলই ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধী। সিপিআইএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা পরেশ অধিকারী বিষয়টি বিধানসভায় তোলা হবে বলে বিক্ষুব্ধদের আশ্বস্ত করেন। তাদের সমর্থনে স্থানীয়ভাবে বনধও পালন করা হয়।  

অবশেষে রাজ্য সরকার মেখলিগঞ্জে দুজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়েছেন। তারা ঘোষনা দিয়েছেন পানিশালাকে পুনর্বাসনের জন্য উপযুক্ত জায়গা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে না। ৪৫টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করার জন্য নতুন আরেকটি জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তারা।

সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানিয়েছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। তারা দাবি করেছেন, আন্দোলন করার কারণে পুলিশ যে মামলা দায়ের করেছে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তা নাহলে তারা আবারও আন্দোলন শুরু করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

/এফইউ/