ব্রিটেনে এসিড সন্ত্রাস কি মুসলিমবিদ্বেষী হামলার নতুন হাতিয়ার?

সম্প্রতি এক মুসলিম ব্রিটিশ মডেলের এসিড-সন্ত্রাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাকে মুসলিমবিদ্বেষী হামলা হিসেবে সন্দেহ করছে পুলিশ। ব্রিটেনে বাংলাদেশি ক্রিকেটার 'তামিম ইকবালের স্ত্রী’র ওপর এসিড নিক্ষেপের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাকে’ও ইসলামবিদ্বেষী বর্ণবাদী হামলা বলে সন্দেহ করছেন কেউ কেউ। সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্রিটেনে মুসলিমবিদ্বেষী হামলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হামলায় এসিডের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। ক’দিন আগে পূর্ব লন্ডনে মুসলিমবিদ্বেষী হামলার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত এক বিক্ষোভে একইসঙ্গে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও। ঘটনার শিকার হওয়া মানুষ আর বিশেষজ্ঞ মতামত থেকে জানা গেছে, এসিড সহজলভ্য হওয়ায় তা হয়ে উঠেছে বিদ্বেষী হামলার এক সহজ অস্ত্র।

যুক্তরাজ্যে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
গত ২১ জুন পূর্ব লন্ডনের বেকটনে ব্রিটিশ মুসলিম মডেল রেশাম খান (২১) এবং তার চাচাতো ভাই জামিল মুখতারের (৩৭) ওপর এসিড হামলা হয়। তাদের গাড়ি যখন ট্রাফিক সিগন্যালে অপেক্ষমান তখন জানালা দিয়ে এসিড ছুড়ে মারে এক দুর্বৃত্ত। আর তাতে প্রচণ্ডরকমের দগ্ধ হন দুইজনই। ঝলসে যায় মুখ, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ। রেশাম ও জামিলের ওপর এসিড নিক্ষেপকে মুসলিমবিদ্বেষী হামলা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।

এর মধ্যেই ইংল্যান্ডের এসেক্স কাউন্টির হয়ে একটি ম্যাচ খেলার পরে মঙ্গলবার (১১ জুলাই) আকস্মিকভাবে দেশে ফিরে আসার কথা জানান তামিম ইকবাল। এরপর কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ করা হয় তামিম এবং তার পরিবারের ওপর ইংল্যান্ডে হামলার চেষ্টা হয়েছে। বলা হয়, ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তামিম  তার স্ত্রী ও সন্তানসহ রাতের খাবার খেতে বের হলে কিছু দুর্বৃত্ত তাদের ধাওয়া করে এবং এসিড ছুড়ে মারার চেষ্টা করে। একে বিদ্বেষমূলক হামলা বলেও উল্লেখ করা হয়। পরে অবশ্য এ ক্রিকেটার তার ফেসবুক পেজে দাবি করেছেন, ইংল্যান্ডে এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি। ব্যক্তিগত কারণে সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে এসেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানগুলো বলছে যুক্তরাজ্যে ইসলামবিদ্বেষী হামলার ঘটনা বেড়েছে। জুনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা টেল মামা’র বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ম্যানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজে হামলার পর থেকে যুক্তরাজ্যের এ দুটি শহরে মুসলিমবিদ্বেষী অপরাধের হার বেড়েছে। মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, ইসলামবিদ্বেষী হামলার সংখ্যা গত চার বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ১২ মাসে ৩৪৩টি ঘটনা, ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ১২ মাসে ১,১০৯টি ঘটনা এবং এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ১২ মাসে ১,২৬০টি ইসলামবিদ্বেষী ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। জুনে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাম্বার রুড বলেছিলেন, যে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে সে অনুযায়ী বলা যায় যারা বিদ্বেষমূলক হামলার শিকার হচ্ছেন তাদের অর্ধেকেরও বেশি মুসলিম এবং ধর্মের কারণেই তাদেরকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। জুনে লন্ডনের মেয়র সাদিক খানও হামলা সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে বলা হয়, লন্ডন ব্রিজে হামলার পর থেকে যুক্তরাজ্যে ইসলামোফোবিক হামলার সংখ্যা ৫ গুণ বেড়েছে। আর বর্ণবাদী ঘটনা বেড়েছে ৪০ শতাংশ।

ইসলামফোবিয়াবিরোধী ব্রিটিশ সংগঠন মেন্ডের এক পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে ১ জুলাই ইন্ডিপেনডেন্টে প্রকাশিত এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে বছরে প্রায় ৭ হাজারটি মুসলিমবিদ্বেষী অপরাধ সংঘটিত হয়। ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য থেকে ১,৪৩,৯২০টি মুসলিমবিদ্বেষী ও ইসলামবিদ্বেষী টুইট করতে দেখা গেছে। প্রতিদিন এ ধরনের টুইটের সংখ্যা ৩৯৩।

পূর্ব লন্ডনে বিক্ষোভ
কেবল তাই নয়, বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যুক্তরাজ্যে এসিড ছোড়ার প্রবণতাও বেড়েছে। বিদ্বেষমূলকসহ বিভিন্ন হামলায় এসিডকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে। দাফতরিক পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, গত তিন বছরে লন্ডনে এসিড ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটনের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ইংল্যান্ডের অন্য এলাকাগুলোতে এ ধরনের অপরাধের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ ধরনের হামলার ঘটনা ২০১৪-২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬-২০১৭ সালে বেড়েছে। ২০১৪-২০১৫ সালে লন্ডনে এসিড ব্যবহার করে ১৮৬টি হামলা চালানো হয়েছিল। আর ২০১৬-২০১৭ সালে এ ধরনের হামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৯৭-তে। মার্চে মেট্রোপলিটন পুলিশ জানায়, লন্ডনে এসিড হামলার সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে লন্ডনে ২৬১টি এসিড হামলা হয়েছিল যা ২০১৬ সালে বেড়ে ৪৫৪টিতে দাঁড়ায়।

জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মুসলিমদের মধ্যে ৪৫ শতাংশেরও বেশি মুসলিম থাকেন পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে। ২১ জুন রেশাম ও তার চাচাতো ভাইয়ের ওপর এসিড হামলাও হয়েছে পূর্ব লন্ডনে। এ হামলার পর ওই এলাকায় তুমুল বিক্ষোভ হয়। সেই বিক্ষোভে ইসলামবিদ্বেষ আর এসিড সন্ত্রাস দুই প্রসঙ্গই উঠে আসে।  ‘বর্ণবিদ্বেষী হামলা বন্ধ কর’ এবং ‘কোনও বর্ণবাদ নয়’ লেখা ব্যানার নিয়ে এ বিক্ষোভ করা হয়। লন্ডনে মুসলিমদের ওপর সাম্প্রতিক এসিড হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সংহতি জানিয়ে এক মিনিটের নীরবতাও পালন করা হয়।

এক খোলা চিঠিতে রেশাম খান দাবি করেন, এসিড সহজলভ্য হওয়ায় তা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে সন্ত্রাসীরা। তিনি লিখেছেন, ‘রাস্তাঘাটে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো গ্যাংগুলো এখন বন্দুক ও ছুরির বদলে এসব উপকরণ ব্যবহার করছে। এসিড কেন নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? কারণ স্টোর ও অনলাইনে এসিডজাতীয় উপকরণগুলো সহজলভ্য এবং মাত্র সাড়ে ৬ পাউন্ড খরচ করেই তা পাওয়া যাচ্ছে। আর এসিড রাখা নিয়ে যে আইনগুলো রয়েছে তাও খুব দুর্বল।’ 

বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, ছুরি ও বন্দুকের ব্যবহারের ওপর সীমাবদ্ধতা থাকায় অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য এসিডকে বেছে নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা।  লন্ডনের মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাং বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. সিমন হার্ডিং এর মতে, সন্ত্রাসী গ্যাংগুলো ছুরির বদলে এসিডের দিকে ঝুঁকছে, কারণ ‘এটি বহনে তেমন কোনও বিধিনিষেধ নেই’ এবং এর মধ্য ‘খারাপ কোনও উদ্দেশ্য প্রমাণ করা কঠিন’। তিনি বলেন, ‘একটি ছুরি হামলাকে হত্যা প্রচেষ্টা বলে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু কেউ যদি এসিড হামলা চালাতে গিয়ে ধরা পড়ে তবে তা শারীরিকভাবে মারাত্মক জখম করার অপরাধ।’

/এফইউ/