রবিবার গণভোটে কাতালোনিয়ার ৯০ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছেন। গণভোটে ভোটারদের উপস্থিতির হার ৪২ শতাংশ। কাতালোনিয়া আঞ্চলিক সরকারের প্রধান কার্লোস পুইজমন্ট বলেছেন, কাতালোনিয়ার জনগণ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার পেয়েছেন। কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের সরকার গণভোটের ফল কাতালান পার্লামেন্টে তুলে ধরবে। আমরা চাই, গণভোটের আইন অনুযায়ী পার্লামেন্ট যেন পদক্ষেপ নিতে পারে।
গণভোটের রায় স্বাধীনতার পক্ষে যাওয়ায় কাতালোনিয়ার নেতারা এখন স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যদি তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তাহলে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল রাজয় রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটে পড়বেন। এরই মধ্যে রাজয় কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাপন্থীদের বিরুদ্ধে পুরো জাতিকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ তুলেছেন।
মাদ্রিদকেন্দ্রিক স্প্যানিশ সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে দেশটির সাংবিধানিক আদালত কাতালোনিয়ার গণভোটকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। দেশটির ১৯৭৮ সালের সংবিধানের ডিক্রি অনুসারে দেশকে বিভক্ত করা যাবে না এবং শুধু জাতীয় সরকারের গণভোট আয়োজনের ক্ষমতা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কাতালানরা যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তাহলে স্পেন সরকার দেশটির সংবিধানের ১৫৫ ধারা প্রয়োগ করতে পারে। ওই ধারা অনুযায়ী, সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের অনুমতিতে কাতালোনিয়ার চলমান স্বায়ত্তশাসন বাতিল করতে পারবে মাদ্রিদ। কারণ স্বভাবতই গণভোটের রায় নিয়ে ক্ষুব্ধ স্পেন। তবে তারা হয়তো বিষয়টির রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগী হবে।
কাতালোনিয়া আঞ্চলিক সরকারের প্রধান কার্লোস পুইজমন্ট বলেছেন, ২০ লক্ষাধিক মানুষ কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কাতালোনিয়ার মানুষের কথা যে আসলেই শুনতে হবে; সেটার সম্মানজনক স্বীকৃতি এর মধ্য দিয়ে আমাদের জনগণ আদায় করে নিয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল রাজয়’কে একদিকে যেমন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে অন্যদিকে নিজ দেশের অখণ্ডতার জন্য লড়তে হচ্ছে। ম্যানুয়েল রাজয়-এর সরকারকে এমনিতেই মাদ্রিদের একটি সংখ্যালঘু সরকারকে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে। এখন এই রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ যে বিরোধীরা নেবে না-তার নিশ্চয়তা নেই। সেক্ষেত্রে স্পেনের বর্তমান নেতৃত্বের রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। এরইমধ্যে গণভোটে স্প্যানিশ পুলিশের বাড়াবাড়ি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। বেসামরিক কাতালানদের ওপর স্প্যানিশ পুলিশের ওই হামলায় প্রায় ৮০০ জন আহত হন। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোলিং স্টেশনগুলো থেকে পুলিশ কর্তৃক ভোটারদের চুল ধরে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়ার মতো ভিডিওগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় ম্যানুয়েল রাজয়’কে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন বার্সেলোনার মেয়র আদা কোলাউ।
এদিকে গণভোটের রায়ে স্পেন সরকারের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মধ্যস্থতার আহ্বান জানিয়েছেন অঞ্চলটির নেতা কার্লোস পুইজমন্ট। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কাতালোনিয়ার গণভোট স্পেনের কোনও অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এ ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন রয়েছে।
কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা ৭৫ লাখ। সুইজারল্যান্ডের জনসংখ্যার সমান। স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ এই কাতালোনিয়ায়। স্পেনের উত্তর-পূর্বের এই প্রদেশটির রাজধানী বার্সেলোনা। তাদের আছে নিজস্ব ভাষাও। বার্সেলোনা বিশ্বের অত্যন্ত জনপ্রিয় শহরগুলোর একটি, ফুটবল এবং একইসঙ্গে পর্যটনের কারণে। স্পেনের মোট আয়ের ২০ শতাংশ আসে কাতালোনিয়া থেকে। ইউরোজোনের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ স্পেনের জাতীয় বাজেটের একটা বড় অংশ আসে কাতালোনিয়ার জনগণের দেওয়া রাজস্ব থেকে। ফলে রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি কাতালোনিয়ার অর্থনৈতিক প্রভাবের দিকটিও স্পেন সরকারের চিন্তার কারণ।
কিভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো?
কাতালোনিয়া স্পেনের অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। এর লিখিত ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। স্পেনের গৃহযুদ্ধের আগে এই অঞ্চলের ছিলো বড়ো রকমের স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসনের সময় কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসনকে নানাভাবে খর্ব করা হয়। কিন্তু ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর সেখানকার জাতীয়তাবাদ আবার শক্তিশালী হতে শুরু করে। তীব্র আন্দোলন ও দাবির মুখে ওই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর সেটা করা হয় ১৯৭৮ সালের সংবিধানের আওতায়। স্পেনের পার্লমেন্টে ২০০৬ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এতে কাতালোনিয়াকে আরও কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়। কাতালেনিয়াকে উল্লেখ করা হয় একটি 'জাতি' হিসেবে। কিন্তু সংবিধানে দেওয়া এমন অনেক ক্ষমতা পরে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত বাতিল করে দেয়। আদালতের এমন সিদ্ধান্ত কাতালোনিয়ার মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
স্বায়ত্তশাসন কাটছাঁট করার ফলে ক্ষুব্ধ কাতালানরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বছরের পর বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক মন্দা, সরকারি খরচ কমানোর মতো বিষয়গুলো। ২০১৪ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার প্রশ্নে একটি গণভোটের আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। তখন ভোটার ছিলো ৫৪ লাখ। ভোটে অংশ নেয় ২০ লাখেরও বেশি ভোটার। কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন যে, ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোটার স্পেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় দেন। অর্থাৎ জনরায় হলো কাতালোনিয়া চায় স্বাধীনতা। স্বাধীনতাকামীরা ২০১৫ সালে কাতালোনিয়ার নির্বাচনে জয়লাভ করে। তখন তারা এমন একটি গণভোট আয়োজনের কথা বলে যার আইনি বৈধতা থাকবে এবং সেটা মানতে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হবে। স্পেনের সংবিধানকে লঙ্ঘন করেই তারা এই ঘোষণা দেয়। কারণ সংবিধানে বলা আছে, স্পেনকে ভাগ করা যাবে না।
কাতালান পার্লামেন্টে গণভোটের প্রসঙ্গে একটি আইন তৈরি করা হয় এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। সেখানে রাখা হয় মাত্র একটি প্রশ্ন: আপনারা কি চান কাতালোনিয়া প্রজাতন্ত্রের কাঠামোয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে উঠুক? সেখানে দুটো ভোট দেওয়া উপায় রাখা হয়: হ্যাঁ অথবা না। বিতর্কিত এই আইনটিতে ভোটের ফলাফল মেনে নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। বলা হয় কাতালোনিয়ার নির্বাচন কমিশন গণভোটের ফলাফল ঘোষণার দুই দিনের মধ্যে পার্লামেন্টে কাতালোনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। কাতালান প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, অন্য কোনও আদালত বা রাজনৈতিক শক্তি তার সরকারকে ক্ষমতা থেকে বরখাস্ত করতে পারবে না।
মাদ্রিদের প্রতিক্রিয়া
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখয় এই ভোটকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত মিষ্টভাষী কিন্তু কঠোর ভাষায় বলতে চাই কোনও গণভোট হবে না। এটা হবে না।’
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত কাতালোনিয়ার ওই আইনটিকে বাতিল করে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার কাতালোনিয়ার অর্থনীতি ও পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। এতে করে কাতালানরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে স্বাধীনতার প্রতি মনোনিবেশ করেন ওই অঞ্চলের মানুষ। যার প্রতিফলন দেখা গেছে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটে মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এখন তাদের নেতারা কিভাবে এই জনরায়কে কাজে লাগাবেন বা কতটুকু কাজে লাগাতে পারবেন সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে স্পেনের অসহযোগিতার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা চেয়েছে কাতালোনিয়া। সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স।