বিপ্লবের সাত বছর পূর্তিতে গণবিক্ষোভের প্রস্তুতি তিউনিসিয়ায়

পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট স্বৈরাচারী একনায়কের বিরুদ্ধে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠা তিউনিসিয়ার জেসমিন বিপ্লবের সাত বছর পূর্তিতে ব্যাপক গণবিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দেশটির মানুষ। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর শিক্ষিত সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ আল বোয়াজিজি’র রাজপথে আত্মহননের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ওই বিপ্লব ছড়িয়ে যায় পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। পতন ঘটে তিউনিসিয়ার জায়নুল আবেদিন বেন আলী, মিসরের হোসনি মোবারকের মতো দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা একনায়কদের। তিউনিসিয়ায় ওই বিপ্লবকে বলা হয় ‘জেসমিন বিপ্লব’। তবে ওই বিপ্লবের সাত বছর পর এখনও নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ে রাজপথে নামতে হচ্ছে তিউনিসিয়ার মানুষকে। অন্য আরব দেশগুলোর অবস্থাও এর চেয়ে ভালো কিছু নয়। বরং সৌদি আরবের মতো কিছু দেশে দাবি আদায়ে রাজপথে নামার সুযোগও নেই নাগরিকদের।

noname২০১৭ সালের শেষদিকে নতুন করে রাস্তায় নামে তিউনিসিয়ার মানুষ। বাজেটে নেওয়া কঠোর পদক্ষেপ, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার বিরুদ্ধে হাজারো মানুষের গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত হয় রাজধানী তিউনিসের রাজপথ। এমন পরিস্থিতিতেই পতিত স্বৈরশাসক বেন আলীকে উৎখাতের সাত বছর পূর্তি উদযাপন করবেন দেশটির মানুষ।

এরইমধ্যে জেসমিন বিপ্লবের সাত বছর পূর্তির ক্ষণ গণনা শুরু করেছেন তিউনিসিয়ার মানুষ। এ বছর বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উৎসবে সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আভাস পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে এক বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বামপন্থী রাজনীতিক থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানরাও।

২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি জ্বালানি তেল, কিছু পণ্য, গাড়ির কর, টেলিফোন কল, ইন্টারনেট সংযোগ, হোটেল ভাড়ার মতো বেশ কিছু ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় তিউনিসিয়া সরকার। নতুন বছরের বাজেটে কসমেটিক ও কৃষিজাত পণ্যসহ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কিছু পণ্যের শুল্ক করও বাড়ানো হয়েছে। বিদেশি ঋণদাতাদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সেবা খাতের ব্যয় সংকুচিত করে আনার সরকারি প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর এর পর থেকেই দেশজুড়ে নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ।

‘কাজ, স্বাধীনতা ও জাতীয় মর্যাদার’ দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। হাজারো কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় ‘জনগণ বাজেট কমাতে চায়’।

noname

রাজধানী তিউনিসে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি দলের সঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নেন আমেল বিরিজাব। জাতীয় সনদ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও তিনি বেকার। বিরিজাব বলেন, ‘এখন আবার আমরা কর্মহীন হয়ে পড়েছি।’

বিরিজাব জানান, তার মাস্টার্স ডিগ্রি ছাড়াও বেসরকারি স্কুলে কয়েক বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারপরও সরকার তাকে কোনও চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘বিপ্লবের কয়েক বছর পরও তিউনিসিয়ার এই অবস্থা! সরকার তার জনগণ বা তরুণদের প্রাপ্য অধিকার দিতে পারছে না। এটা সত্যিই দুঃখজনক।’

তিউনিসিয়ার উত্তরপশ্চিম প্রদেশ থেকে এসে মিছিলে অংশ নিয়েছেন বামপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট রাচিদা ঘেরিয়ানি। তিনি বলেন, ‘এখানে দারিদ্রতা ছাড়া কিছুই নেই। বিপ্লবের পর কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমাদের বিপ্লব চুরি করা হয়েছে। জনগণ কিছুই পায়নি। উল্টো আমাদের জীবনমান প্রতিদিন কমে যাচ্ছে। এখানে মধ্যবিত্ত বলে কিছু নেই।’

আমানি আবিদ নামের এক বিক্ষোভকারী হাতে একটি হলুদ কার্ড নিয়ে মিছিলে অংশ নেন। আল জাজিরা’কে তিনি বলেন, ‘আজকের মিছিল সরকারের জন্য হলুদ কার্ড। ২০ তারিখে লাল কার্ড দেখানো হবে।’

তিউনিসিয়ার সরকার বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও লুটপাটের অভিযোগ তুলেছে। কয়েকটি বিক্ষোভের ঘটনা রাতের বেলায় ঘটেছে।

nonameবিক্ষোভে বিদেশি ইন্ধনের কথা বললেও ১৩ জানুয়ারি শনিবার রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন এবং চাকরিদাতাদের সঙ্গে দুই ঘণ্টার জরুরি বৈঠকে বসেন তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট। সেখান থেকে সংস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। দেশটির সামাজকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ ত্রাভেলসি জানান, সহায়তার অপেক্ষায় থাকা মানুষদের জন্য কল্যাণ ভাতার পরিমাণ ১৭ কোটি দিনার (৭ কোটি ডলার) বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

সামাজকল্যাণমন্ত্রী বলেন, এর মাধ্যমে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া যাবে। এছাড়া চিকিৎসা সেবা ও গৃহায়নে সংস্কার আনা হবে।

বাজেট নিয়ে বিক্ষোভ শুরুর পর দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বিক্ষোভ মোকাবিলায় রাজধানীতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

জাতিসংঘের হিসাবে, সাম্প্রতিক বাজেটবিরোধী বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৭৭৮ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনই ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী।

উল্লেখ্য, জেসমিন বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত একনায়ক বেন আলি ১৯৮৭ সাল থেকে তিউনিশিয়া শাসন করে আসছিলেন। ওই অঞ্চলের অন্য অনেক দেশের মধ্যে বেশ সমৃদ্ধিশালী হিসেবেই পরিচিত ছিল তিউনিসিয়া। তবে সেই সমৃদ্ধি আপামর জনতার কল্যাণে কাজে লাগেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সমর্থনপুষ্ট ওই সরকার জনগণের যে কোনও ক্ষোভ ও প্রতিরোধকে কঠোর হাতে দমন করতো। কিন্তু মোহাম্মদ বিন বোয়াজিজির আত্মাহুতিতে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে এলে পিছু হটতে বাধ্য হয় বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিক্ষোভ দমনে অভ্যস্ত সরকার। সূত্র: আল জাজিরা, মিডল ইস্ট আই।