কমিউনিটিভিত্তিক স্থানীয় পত্রিকাগুলোকে বলা হয়ে থাকে গণতন্ত্রের প্রাণ। যাদের কণ্ঠস্বর সমাজের উঁচু তলায় পৌঁছায় না, সেই তাদের কথা তুলে ধরতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে এইসব সংবাদমাধ্যম। যুক্তরাজ্যে এই স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই বিতরণ করা হয় বিনামূল্যে। তবে সেই স্থানীয় পত্রিকাগুলোর ভয়াবহ আকাল চলছে যুক্তরাজ্যে। বিজ্ঞাপনের ওপর ভরসা করে টিকে থাকা এইসব সংবাদমাধ্যমের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে নয়া যোগাযোগ প্রযুক্তি। ইন্টারনেটভিত্তিক মিডিয়ার জোয়ারের কারণে এইসব সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কমেছে ভয়াবহভাবে, যা এই ধারার পত্রিকাগুলোর অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২শ’ সংবাদপত্রের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা। স্থানীয় পত্রিকাগুলোকে বাঁচাতে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন কিনা, তা পর্যালোচনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। এমন বাস্তবতায় বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় পত্রিকাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়লে গণতন্ত্রও হুমকির মুখে পড়বে।
সংবাদপত্রের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে বেশিরভাগেরই জন্ম স্থানীয়ভাবে। নির্দিষ্ট এলাকা বা জনগোষ্ঠীর জন্যই এগুলো প্রকাশিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো বিনামূল্যেই বিতরণ করা হতো স্থানীয়দের মাঝে। এগুলো ভূমিকা রাখতো স্থানীয় জনতার কণ্ঠস্বর হিসেবে। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’কে উদ্ধৃত করে সে দেশের সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, ২০০৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ স্থানীয় সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। সাংবাদিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫০০। দেশটির ৫৮ শতাংশ এলাকায় কোনও স্থানীয় সংবাদপত্র নেই এখন।
বিনামূল্যে বিতরণের কারণে স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর আয়ের উৎস শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন। আকার ও রংয়ের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপনদাতারা এখানে বিনিয়োগ করেন। কখনও মলাট বিজ্ঞাপনও দেন তারা। থাকে ইনসার্ট বিজ্ঞাপনও। মূলধারার এই বিজ্ঞাপন ছাড়াও শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপন থেকেও ভালো আয় হতো এই ধারার পত্রিকাগুলোর। আর হারিয়ে যাওয়া, ক্রয়-বিক্রয়, নিখোঁজ সংবাদের মতো বিজ্ঞাপন এসব কমিউনিটি নিউজপেপার বা স্থানীয় সংবাদপত্রে খুবই কার্যকরী বলে এই ধারার বিজ্ঞাপন থেকেও আসতো রেভিনিউ। সেই বিজ্ঞাপন কমে যাওয়াকেই বিপুল পরিমাণে স্থানীয় সংবাদপত্র বিলুপ্ত হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে শনাক্ত করা গেছে।
ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা জনস্টন প্রেস জানিয়েছে, ২০১৭ সালে বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয় ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০০.২ মিলিয়ন পাউন্ডে। ২০০টি পত্রিকা প্রকাশ করা এই সংস্থার মালিক বলেছেন, ‘ব্যবসা এখন প্রতিকূলে। জাতীয় বাজারে উন্নতি করার কোনও লক্ষণ আমরা দেখছি না। আয়ের ক্ষেত্রে আমাদের ধারণার চেয়ে বেশি চাপ পড়ছে, ব্যয়ও কমাতে হচ্ছে।’ অন্যান্য অনেক সংবাদ সংস্থারও একই অবস্থা। সাম্প্রতিক সময়ে সবারই বিজ্ঞাপনপ্রাপ্তির হার অনেক কমে গেছে। পাঠকরাও এখন গুগল ও ফেসবুক নিয়েই বেশি ব্যস্ত। বিজ্ঞাপনদাতারাও ছুটছে সেখানে। মার্কিন বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান টাবুলার প্রধান নির্বাহী অ্যাডাম সিঙ্গোলডা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট এ লেখা এক কলামে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের সামনে এখন প্রশ্ন, বিজ্ঞাপনদাতারা কেন এই স্বল্পসংখ্যক পাঠকের জন্য বিনিয়োগ করবে?’ তিনি বলেন, ‘আমি স্থানীয় সাংবাদিকতা খুবই জরুরি বিবেচনা করি। তবে এর আবেদন আগের মতো নেই। আমাদের চোখের সামনেই এগুলো বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করেছে।’
২০১৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় যুক্তরাজ্যের যেসব শহরে স্থানীয় পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে সেখানেই গণতন্ত্র ব্যহত হয়েছে। স্থানীয়দের মাঝে যোগযোগ সীমিত হয়েছে এবং অবিশ্বাস ও বিবাদ বেড়েছে। লন্ডনের কিংস কলেজের যোগাযোগ, গণমাধ্যম ও ক্ষমতা বিষয়ক কেন্দ্রের পরিচালক ড. মার্টিন মুর বলেন, ‘আমাদের সবারই হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাউন্ট আছে। তবে স্থানীয় পত্রিকাগুলো হারিয়ে গেলে আমরাও হারিয়ে যাই।’
জন ডব্লিউ হোয়াইটহেড বলেন, কর্পোরেট মিডিয়াতে অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারেন না সাংবাদিকরা। বিভিন্ন চাপে আড়ালেই থেকে যায় প্রকৃত ঘটনা। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো এদিক থেকেও অনন্য। হোয়াইটহেড মনে করেন, স্থানীয় সংবাদপত্রে সেসব খবর পাওয়া যায় যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলো দিতে পারে না। তিনি আব্রাহাম লিংকনের গুরুত্বপূর্ণ উক্তি ‘জনগণই ক্ষমতা’ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সেই জনগণের সবচেয়ে বেশি কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয় এই স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে।’
আরও পড়ুন