কাশ্মিরে মানবাধিকার হরণ: জাতিসংঘ কমিশনের প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ভারত-পাকিস্তান

ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মির ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ-কাশ্মিরে মানবাধিকার হরণের অভিযোগ তুলেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। ৪৯ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেছে জাতিসংঘ কমিশন। সীমান্তরেখার উভয়পার্শেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের আলামত পেয়েছে তারা। জরুরি ভিত্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। প্রায় ৭ দশক ধরে কাশ্মিরবাসী নিপীড়নের শিকার। সেখানে চলা সহিংসতা প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতর থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।

Screenshot_2018-06-14-15-21-06-035_com.facebook.katana-800x445

মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জায়েদ রাদ আল হোসেন বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও বিবাদ চলছেই। এই সহিংসতা থেকে নেই। আর এই সহিংসতায় লাখ লাখ মানুষ তাদের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত এই দুর্দশা চলছে। হাইকমিশনারবলেন, ‘কাশ্মিরে নেওয়া যেকোনও রাজনৈতিক সমাধানের আগে এই সহিংসতা বন্ধ নিশ্চিত করা জরুরি। একইসঙ্গে পূর্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমি জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলকে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানাই যেটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাশ্মিরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করবে।’

সাম্প্রতিক সময়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি কথা উল্লেখ করে জায়েদ হোসেন বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর উচিত সর্বাত্মকভাবে আন্তর্জাতিক আইন মেনে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া। ভবিষ্যতেও যেসকল সহিংসতা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সেগুলোও দমন করা দরকার। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে হবে যেন অনেকদিন ধরে চলা আসা নিরাপত্তা বাহিনীর জোরপূর্বক বলপ্রয়োগের ঘটনা আর না ঘটে।’ গত দুই বছর ধরেই ভারত ও পাকিস্তানকে এই আহ্বান জানিয়েছে আসছে মানবাধিকার কমিশন। এরপরও সংস্থাটিকে কোনও পক্ষই প্রবেশাধিকার দেয়নি। দূরবর্তী অবস্থান থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনটিতে মূলত ২০১৬ সাল থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। সে বছরই পুলিশের ‍গুলিতে বিদ্রোহী নেতা বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর হাজার হাজার কাশ্মিরবাসী রাজপথে নেমে আসে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকে। দেশটির সিভিল সোসাইটিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত অন্তত ১৪৫ জন বেসামরিককে হত্যা করেছে পুলিশ। আর সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে ২০ জন বেসামরিক। ২০১৬ সালে আন্দোলনরত কাশ্মিরিদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্রের প্রয়োগ করা হয়। সে সময় ব্যবহৃত ছোড়ড়া গুলির প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। কর্মকর্তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই  গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১৭ জন। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ২২১ জন।

1528963025_world-photography-day

প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকা ও আইন নিশ্চিত করতে না পারাটাই জম্মু-কাশ্মিরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার এক্ট ১৯৯০ ও পাবিলক সেফটি এক্ট ১৯৭৮ এমন একটি আইনি কাঠামো তৈরি করেছে যা স্বাভাবিক আইনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকাররা এতে করে বিপাকে পড়ে যান। এফএসপিএ অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর কোনও সদস্যে বিচার হবে না। এজন্য ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এতে করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যা খুশি তাই করতে পারেন। গত ২৮ বছর ধরে এই আইন বহাল আছে এবং এখন পর্যন্ত একজন সদস্যেরও বিচার হয়নি। এছাড়া কাশ্মিরে বেড়ে চলেছে অপহরণ ও গুমের ঘটনা। এর সঠিক তদন্তও হয় না অনেক সময়। কাশ্মির উপত্যকা ও জম্মুতে পাওয়া গেছে গণকবরও। 

যৌন নিপীড়নকারীদেরও এখানে সাজা হয় না। ২৭ বছর আগে আলোড়ন তোলা কুনান-পুসপোরা ধর্ষণের বিচারই এখনও হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বারবার আইনের আশ্রয় নিতে চাইলেও নিপীড়নের শিকারের পরিবার সেটা পায়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জম্মু ও কাশ্মিরে ১৯৮০ সাল থেকে কার্যক্রম চালানো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যা ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগও রয়েছে। পাকিস্তান এমন গোষ্ঠীকে সমর্থন করে না দাবি করে আসলও বিশেষজ্ঞদের ধারণা ইসলামাবাদ থেকে তাদের সামরিক সহায়তা করা হয়।

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। বলা হয় এখানে আরও কাঠামোবদ্ধভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরে বাকস্বাধীনতা নেই। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করারও সুযোগ মেলে না কাশ্মিরবাসীর।

Dfo3aAAWAAEFxHs

প্রতিবেদনে বলা ইস্যুগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এই দুই জায়গার সঙ্গে পাকিস্তানের সাংবিধানিক সম্পর্ক। ইতিহাসের শুরু থেকেই আজাদ কাশ্মির পাকিস্তনের নিয়নত্রণে। গিলগিত বালতিস্তানেও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের। ফেডারেল গোয়েন্দারাও পুরো অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছেন। একটি জাতীয় এনজিওকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টে বলা হয়, গিলগিত-বালতিস্তানে আইন ব্যবহার করে শত শত মানুষকে বন্দি করেছে। যারাই মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে গেছে তাদেরই জেলে যেতে হয়েছে। প্রতিবেদনে ভারত ও পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়।

পরিস্থিতির উন্নয়নে মানবাধিকার কমিশন কিছু সুপারিশ করে। তা হলো,  ভারতের উচিত এএফএসপিএ আইনটি সংস্কার করা, ২০১৬  এর জুলাই থেকে সশস্ত্র বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত বেসামরিকদের ব্যাপারে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা, হতাহতদের পরিবারের পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। প্রতিবেদনে বলা হয়, পিএসএ আইনও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনেই অনুসরণ করা উচিত। প্রশাসনের হাতে যারা আটক, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করতে হবে নয়তো মুক্তি দিতে হবে।

পাকিস্তানের কাছে মানবাধিকার কমিশন আহ্বান জানায় যেন সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অপব্যবহার না হয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও সামাজিক কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার জন্য যেন এই আইন ব্যবহার করা না হয়। আজাদ কাশ্মিরের অভ্যন্তরীণ সংবিধানে বাকস্বাধীনতা নেই, করা যায় না শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার বলে জানায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। মত প্রকাশ করতে গিয়ে যদি কোনও রাজনৈতিক কর্মী কিংবা সাংবাদিক আটক হয়ে থাকে তবে তাদেরও মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানায় সংস্থাটি। তারা বলেন, আজাদ কাশ্মির ও গিলতি বালতিস্তানের সংবিধানের সংশোধনী করা প্রয়োজন। আহমেদিয়া মুসলিমদের সংবিধানের মাধ্যমেই ‘অপরাধী’ করে রাখা হয়েছে। সংশোধন প্রয়োজন সেই আইনেরও।