জাতিসংঘ অধিবেশন: বিতর্কের প্রথম দিনে জলবায়ু ইস্যুর প্রাধান্য

মঙ্গলবার (২৫ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক বিতর্কের প্রথমদিনের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল জলবায়ু ইস্যু। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ বিশ্বনেতারা এদিন জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলেন। গুতেরেস অভিযোগ করেন, বিশ্বনেতারা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেননি। উষ্ণতা বৃদ্ধির ভয়াবহতাকে মানুষ আর প্রকৃতির জন্য হুমকি আখ্যা দিয়ে তিনি অবিলম্বে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পক্ষ থেকে নিজ নিজ ঝুঁকি ও বিপন্ন পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা হয়। কেবল প্রকৃতি-প্রতিবেশ নয়, একে শান্তি-স্থিতিশীলতা-সমৃদ্ধির প্রতিও হুমকি আখ্যা দেওয়া হয় বিশ্বনেতাদের পক্ষ থেকে। অধিবেশনের বিতর্কে প্যারিসে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তারা।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন
সেই শিল্পায়নের যুগ থেকে মুনাফার স্বার্থে মানুষ প্রকৃতির দিতে খেয়াল না করেই পুড়িয়ে যাচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি, বায়ুমণ্ডলে জমা করেছে কার্বনের অভিশাপ। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত প্রমাণ হাজির করেছেন,শিল্পোন্নত দেশগুলোর এই মুনাফার উন্মাদনার কারণেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ঋতু বৈচিত্র্য। ওজনস্তরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ফুটো। গলতে শুরু করেছে দুই মেরুতে জমে থাকা বরফ। জলবায়ুর প্রভাবজনিত কারণে বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা,কৃষিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়। ক্রমাগত জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হচ্ছে মানুষ।  

মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদের এ বছরের বিতর্কের প্রথম দিনে বার বারই আলোচনায় এসেছে জলবায়ু ইস্যু। এদিন উদ্বোধনী ভাষণে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারকে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি সংকটপূর্ণ মুহূর্তে পৌঁছেছি। আগাম দুই বছরে যদি আমরা আমাদের আচরণ না পাল্টাই, তবে লাগামছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’

বক্তব্যে গুতেরেস জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি সংশ্লিষ্ট ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। এ দুই সমস্যাকে যুগোপযোগী চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলকে উদ্ধৃত করে গুতেরেস বলেন, পৃথিবী উষ্ণতর হচ্ছে, কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব বাড়ছে। বিশ্বনেতাদের সতর্ক করে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের থেকে ঢের দ্রুতগতিতে, আর পরিবর্তনের সেই গতি বিশ্বজুড়ে জীবনের আর্তনাদকে তীব্রতর করবে।’

অধিবেশনে পেরুর প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভিজকারা করনেজো বলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে নাজুক দেশগুলোর একটি পেরু। জীববৈচিত্র্য হলো আমাদের মুখ্য প্রাকৃতিক মূলধন যার উপর আমরা নির্ভর করতে পারি। তবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং খরা ও প্লাবনের মতো চরম জলবায়ু পরিস্থিতি আমাদেরকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দেয়।’

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের প্রতীকী ছবি
প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের বিপন্নতার প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ নামের একটি সম্মেলনে প্রথমবারের মতো একটি জলবায়ু চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হন বিশ্বনেতারা। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ১৭৫টি দেশ ওই সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তির আওতায় বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। চুক্তির লক্ষ্যমাত্রায় আরও রয়েছে- গাছ, মাটি ও সমুদ্র প্রাকৃতিকভাবে যতটা শোষণ করতে পারে, ২০৫০ সাল থেকে ২১০০ সালের মধ্যে কৃত্রিমভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ সেই পর্যায়ে নামিয়ে আনা। বারাক ওবামার নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র ওই জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও  ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৭ সালের জুনে চুক্তি থেকে সমর্থন তুলে নেন।

মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নিয়েতো জাতিসংঘের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। এদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তলিয়ে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র মার্শাল ‌আইল্যান্ডস। মঙ্গলবার সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে দেশটির প্রেসিডেন্ট হিলদা হেইনে জরুরি ভিত্তিতে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মার্শাল আইল্যান্ডস-এর ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় মধ্যে রয়েছে। যদিও দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে আমরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছি, তবে এ হুমকি আমাদের একার নয়। শুধু ছোট ছোট উন্নয়নশীল দ্বীপরাষ্ট্রগুলোই যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে তা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা অন্য দেশগুলোকেও পাশে পাচ্ছি।

সিসিলির প্রেসিডেন্ট ড্যানি ফাওরে সতর্ক করেন, শান্তি ও সমৃদ্ধিও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত নয় এবং এটি গোটা বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের বিষয়টি এড়িয়ে গেলে বিশ্ব এমন এক ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছাবে যে ভবিষ্যত প্রজন্ম তা আর ঠিক করতে পারবে না।’ মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজিস্তানের প্রেসিডেন্ট সুরোনবে জিনবেকোভ সতর্ক করে বলেছেন, তার দেশের হিমবাহ ও পানি সম্পদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বেড়ে যাচ্ছে।