নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের খসড়া প্রস্তাব, চীন-রাশিয়ার আলোচনা বয়কট

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট সংক্রান্ত এক খসড়া প্রস্তাবের আলোচনা বয়কট করেছে চীন ও রাশিয়া। রাখাইন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ-মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের উদ্যোগে ওই প্রস্তাব আনা হয়েছিল। প্রস্তাবে জাতিসংঘ-মিয়ানমার চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রসঙ্গ ছিল। কূটনীতিক সূত্রে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, খসড়া প্রস্তাব সংক্রান্ত আলোচনায় অনুপস্থিত ছিল চীন আর রাশিয়া। উল্লেখ্য, অতীতেও একাধিকবার ওই দুই স্থায়ী সদস্যের বিরোধিতায় নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হয়।

কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করে আসলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না মিয়ানমার। গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া এসব রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এখনও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন।

কূটনৈতিক সূত্রকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, এ বছরের নভেম্বরে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব ‌আনে যুক্তরাজ্য। মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ভয়াবহতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার স্বেচ্ছামূলক-নিরাপদ-মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতেই ওই প্রস্তাব আনা হয়। কূটনীতিকরা জানিয়েছে, এ নিয়ে কয়েক দফায় আলোচনা হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের উত্থাপিত প্রস্তাবে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষরিত মিয়ানমারের চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। জুনে মিয়ানমারের নেপিদোতে ওই সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চুক্তিটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন মিয়ানমারে নিয়োজিত জাতিসংঘের আবাসিক এবং মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়কারী নাট ওৎসবি। এক সংবাদমাধ্যমকে সে সময় তিনি জানান, ‘রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে যথাযথ পরিবেশ গড়ে তোলার কাজে সহায়তার জন্য ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষর করেছে।’

যুক্তরাজ্যের খসড়া প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমার কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গ রয়েছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের নিয়মিত নিরাপত্তা পরিষদের কাছে রিপোর্ট করার তাগিদও দেওয়া হয়েছে এতে। তবে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় চীন-রাশিয়ার অনুপস্থিতি একে সংশয়ের মুখে ফেলেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার দূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া সোমবার রয়টার্সকে বলেন, 'আমার কাছে এটি যথাযথ সময়োপযোগী ও অর্থপূর্ণ কিছু মনে হয়নি।'  চীনা দূত মা ঝাওজু এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সংস্থাটিতে নিযুক্ত মিয়ানমারের প্রতিনিধিও তাৎক্ষণিকভাবে এ  ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে অপারগতা জানিয়েছেন।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, খসড়া প্রস্তাবটি ঠিক কখন ভোটাভুটির জন্য তোলা হবে, অথবা আদৌ তোলা হবে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়।প্রস্তাবটি অনুমোদন পেতে হলে ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে অন্তত ৯ সদস্য রাষ্ট্রের ভোট নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি চীন-রাশিয়াসহ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী কোনও সদস্য দেশ যেন ভেটো না দেয় তাও নিশ্চিত করতে হবে ।স্থায়ী সদস্যদের কেউ ভেটো দিলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে চীন-রাশিয়া শুরু থেকেই রোহিঙ্গা নিধন প্রশ্নে প্রায় নীরব অবস্থান জারি রেখেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অধিকার রক্ষায় মিসরের পক্ষ থেকে আনা প্রস্তাব  নাকচ করে দেয় চীন। অক্টোবরে নিরাপত্তা পরিষদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ৩টি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনও প্রস্তাব আনা যায়নি। কূটনৈতিক সূত্রকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সে সময় জানায়, ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন চীন আর রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সংকট নিরসনে কোনও প্রস্তাব আনার ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।