পশ্চিমবঙ্গেও কেন গেরুয়া ঝড়?

ভারতের সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। পার্লামেন্টে ৫৪৫টি আসনের মধ্যে তিন শতাধিক আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। তবে এবার পশ্চিমবঙ্গেও উত্থান ঘটেছে বিজেপি তথা গেরুয়া শিবিরের। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এ রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে মাত্র দুইটিতে জয় পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু এবার সেখানে ১৬টি আসনে এগিয়ে রয়েছে নরেন্দ্র মোদির দল। কিন্তু ঠিক কী কারণে পশ্চিমবঙ্গে এমন গেরুয়া ঝড়? যে ঝড়ে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে রাজ্যে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস!

noname২৩ মে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত পোস্টাল ব্যালট গণনা পর্বে পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে ২৪টিতে এগিয়ে আছে তৃণমূল। অথচ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে ৩৪টি আসন পেয়েছিল দলটি। অর্থাৎ, ১০টি আসন হাতছাড়া হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূলের।

অন্যদিকে গতবারের চেয়ে এবার বিজেপি-র আসন বাড়ছে ১৪টি। ১৬টি আসন পাচ্ছে নরেন্দ্র মোদির দল। বাকি দুটিতে জয় পেতে যাচ্ছে কংগ্রেস। ভোটের ফলাফল সামনে আসতে শুরু করার পরই যেটা অনেকের কপালে ভাঁজ ফেলেছে কিংবা অন্য কারও মুখে হাসি – সেটা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র ভোটের অঙ্ক ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার ঘটনা।

২০১৬ সালের পর থেকে যেভাবে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে বিজেপি তাদের ভোট বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে, আর মোটামুটিভাবে দ্বিতীয় স্থানটা ধরে রাখতে পারছে, তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন ঘটনা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিমল শঙ্কর নন্দ বিবিসি বাংলা-কে বলেন, ‘দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে বিজেপি থাকতে পারছে কিনা, সেটা আমার কাছে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেটা গুরুত্বের, তা হচ্ছে দলটি কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ভোট বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। বিগত বেশ কয়েকটা নির্বাচনের ফল দেখলেই সেটা স্পষ্ট হবে।’

এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের অন্য নির্বাচনগুলোতেও বিজেপি-র ভোটের হার বেড়েছে। একসময় ক্ষমতাসীন তৃণমূলের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে যে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস ছিল রাজ্যে তাদের ক্ষয় অব্যাহত রয়েছে।

প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার শুভাশীষ মৈত্র ব্যাখ্যা করছিলেন, ‘২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে যতগুলো ভোট হয়েছে রাজ্যে সবক্ষেত্রেই বিজেপি দ্বিতীয় স্থানটা ধরে রাখছে। কোথাও তৃতীয় হলেও সেটাও খুব কম মার্জিনে। কথা হল বিজেপি-র দিকে ভোটটা আসছে কোথা থেকে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট তো কমছে না, উল্টে বাড়ছে। আবার প্রতিষ্ঠিত দুটি রাজনৈতিক শক্তি ছিল - বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস, তাদের যতটা ভোট কমছে, সেই ভোটই বিজেপির দিকে যাচ্ছে। তাই কংগ্রেস আর বামেদের ভোটই যে মোটামুটি ভাবে বিজেপি পাচ্ছে, এটা বলা যায়।’

নিজেদের দিকে ভোট কীভাবে টানতে পারছে বিজেপি?

বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ব্যাখ্যা দেয় যে, ভোটারদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে ভোট বাড়াচ্ছে বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি জায়গায় ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। পেশীশক্তি দেখাতে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো বিক্ষোভও দেখিয়েছে। কিন্তু শুভাশীষ মৈত্রের মতে, অন্যান্য রাজ্যের মতো সম্পূর্ণ ধর্মীয় মেরুকরণ পশ্চিমবঙ্গে করা সম্ভব নয়।

তিনি বলছিলেন, ‘কিছুটা মেরুকরণ তো হয়েইছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা, কিছু মিছিল - এসব দেখেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু এই ভোটে মেরুকরণের ছাপ আমি দেখতে পাচ্ছি না খুব একটা। আর আমার মতে, এটা তো রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের দেশ - এখানে অন্য রাজ্যের মতো ধর্মীয় মেরুকরণ সম্ভবও নয়।’

২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের দুটি উপনির্বাচনেও দ্বিতীয় স্থান দখলে সমর্থ হয়েছিল বিজেপি। ওই নির্বাচন নিয়ে শুভাশীষ মৈত্রের ভাষায়, ‘বীরভূম বা কোচবিহারের মতো কয়েকটি জেলা থেকে খবর পেয়েছি যে সেখানে মুসলমানদের একটা অংশ - যারা কোনও কারণে তৃণমূল কংগ্রেসের ঘোরতর বিরোধী, তারাও কিন্তু বিজেপি-র দিকে গেছেন। যদিও এটা রাজ্যের সার্বিক চিত্র নয় এবং ওই সব অঞ্চলে মুসলমানদের বিজেপিকে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় কিছু ইস্যুই মূলত কাজ করেছে।’

অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছিলেন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জড় পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই থেকেছে, কিন্তু বামপন্থীদের প্রভাবে সেটা এতদিন সামনে আসতে পারে নি। তার ভাষায়, ‘সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দিকে একটা সমর্থন ছিলই। কিন্তু জনসংঘের ব্যর্থতা হল স্বাধীনতার পরে তারা এটাকে কাজে লাগাতে পারে নি - বিশেষত দেশভাগ, উদ্বাস্তুদের সমস্যা - এইসব ইস্যুকে তারা সামনে নিয়ে আসতে পারেনি। যে কাজটা করেছিল কমিউনিস্টরা। মানুষের একটা বিরাট অংশের সমর্থন তাই কমিউনিস্টদের দিকে চলে গিয়েছিল।’

তার মতে, ২০১১ সালে যখন কমিউনিস্টরা বিদায় নিলো পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা থেকে, ওই যে মানুষ বিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিলেন, তারা বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়লেন। মূলত এর ফলেই ক্রমাগত বিজেপি-র ভোট বেড়ে চলেছে।

একদিকে বাম ও কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়, অন্যদিকে বিজেপি-র দ্বিতীয় শক্তি হিসাবে সামনে উঠে আসা - এটাকেই বিশ্লেষকরা এখন পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজনৈতিক ট্রেন্ড বলে মনে করছেন। সর্বশেষ যার প্রমাণ মিলছে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে। সূত্র: বিবিসি।