‘ল্যাংড়া’ থেকে সন্ত্রাসী অতঃপর সমাজসেবী

ছোটবেলায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একটি পা হারানোর পর কিভাবে সন্ত্রাসীদের পাল্লায় পড়েছিলেন, আবার কিভাবে সেই সহিংসতার পথ ছেড়ে মানব কল্যাণে নিজেকে জড়িয়েছেন-তা নিয়ে একটি আত্মকথন লিখেছেন এক ভারতীয় সমাজকর্মী। আর সে লেখাটি তিনি প্রকাশ করেন অনুপ্রেরণামূলক ওয়েবসাইট হিউম্যান বোম্বেতে। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য লজিক্যাল ইন্ডিয়ানেও। তবে সে ব্যক্তির নাম জানা যায়নি। ভারতীয় সমাজকর্মীর সে আত্মকথন ভাষান্তরিত করে তুলে ধরা হল-

‘একদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে একটি ট্রাক আমার পায়ের উপর দিয়ে চাপা দিয়ে গেল। আমাকে দ্রত হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক বললেন, আমার পা টিকে রক্ষা করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন পড়বে ২৫ হাজার রুপি। আমার পরিবার এতোটাই দরিদ্র ছিল যে অত টাকার কথা চিন্তাও করতে পারতো না।

পা হারানো সে ভারতীয় সমাজসেবী

ছয়বার আমার পা কাটা হলো। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম জীবন কতোটা কঠিন। সেই ৬ বছর বয়স থেকে আমার নাম হয়ে গেল ‘ল্যাংড়া’। আমি খেলতে চাইলে অন্যরা খেলায় নিতো না। তারা বলতো, আমি বল নষ্ট করে ফেলব।

আমার বাবা আমাকে বোঝা ভাবতে লাগলেন। তিনি আমাকে প্রায়ই পেটাতেন। ১৫ বছর বয়সে আমি বাড়ি ছাড়লাম। সিদ্ধান্ত নিলাম উপার্জন করব। আত্মনির্ভরশীল হব। ছোটবেলা থেকেই রাস্তায় একটি সন্ত্রাসী দলকে দেখতাম। দ্রুত টাকা উপার্জনের আশায় আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। ছুরি নিয়ে ঘুরতাম, লোকজনকে মারতাম আর টাকা ছিনিয়ে নিতাম। তিনবার আমাকে জেলেও যেতে হয়েছে। একটা অন্ধকার সময় ছিল আমার জন্য কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কী করব। আয়-উপার্জন নেই। অস্থির হয়ে উঠলাম। ১৯৯৪ সালে আমাকে দেখলেই গুলি করার আদেশ দেওয়া হয়।

এক রাতে আমি যখন লুকানোর চেষ্টা করছিলাম তখন ৬ ফুট উচ্চতার এক লোক আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমি পুলিশ ভেবে ছুরি বের করতে লাগলাম। কিন্তু কোনও কিছু ঘটার আগে লোকটি আমাকে বললেন, বাবা, যিশু তোমাকে ভালোবাসেন। তোমার প্রতি তার অনেক আশা।’ লোকটি বেশ কয়েক ঘণ্টা আমার হাত ধরে রাখলেন, কথা বললেন, আমাকে বোঝালেন যে জীবন শেষ হয়ে যায়নি- যে কথাটি আমার বাবা কখনও বোঝানোর চেষ্টা করেননি।

আমি লোকটিকে বললাম যে যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন তবে তাকে বলুন আমাকে যেন এ নরক থেকে সরিয়ে নেয়। আর এরপর থেকে লোকটি আমার দিক নির্দেশকে পরিণত হলেন। আমাকে সংশোধন করার চেষ্টা করলেন। আমি ২ বছর একটি এনজিওতে ছিলাম। সেখানে তারা আমার শরীরে কৃত্রিম পা সংযোজন করলেন। আর তখনই আমি স্বপ্ন পূরণের প্রেরণা পেলাম। তারা পুলিশের সঙ্গে কথা বললেন। বোঝালেন, আমার বয়স এখনও ১৮ হয়নি এবং আমি সংশোধিত হয়ে গেছি। পুলিশও আমাকে শেষ সতর্কতা দিয়ে চলে গেল।

এরইমধ্যে আমার কাছে বাবার মৃত্যুসংবাদ এলো। মা আর ভাই-বোনদের ভরণপোষণের জন্য আমি কাজ করতে শুরু করলাম। সারাদিন এনজিওতে কাজ করার পর বিকেল ৪ থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নৈশ স্কুলে পড়াতাম। এরপর রাত ১‌১ টা পর্যন্ত একটা হোটেলে কাজ করতাম। ছুটির দিনে আমি মোজা বিক্রি করতাম এবং টাকা জমাতাম। এভাবে দুই বছর চললো। এরপর এনজিএতে আমার পদোন্নতি হলো। আমাকে পর্তুগাল পাঠানো হলো। আমি আরও উপার্জন করতে লাগলাম। বিয়ে করলাম। কিন্তু আমার ছেলের জন্মের সময় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে স্ত্রী মারা গেল।

এরপর আমি নিজেকে সামাজিক কার্যক্রমে জড়িয়ে ফেললাম। গত ১৩ বছর ধরে আমি অনেক কিছু করেছি। প্রতিবন্ধীদের হয়ে ক্রিকেট খেলেছি, পথশিশুদের জন্য কাজ করেছি, বন্যাদুর্গতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছি। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে সেই লোকটির জন্য যিনি আমাকে পথ দেখিয়েছেন। আর তাই আমি বলতে চাই- একটি মানুষই পারে ভিন্নতা নিয়ে আসতে। সূত্র: দ্য লজিক্যাল ইন্ডিয়ান

/এফইউ/