পশ্চিমবঙ্গে বন্ধু পাতানোর অভিনব মেলা

সময়ের সঙ্গে বদলেছে বন্ধুত্বের ধরন। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এখন এক ক্লিকেই 'ফ্রেন্ড' আবার এক ক্লিকেই 'আনফ্রেন্ড' করা যাচ্ছে। কিন্তু এই গতিশীল জীবনের মধ্যেও বিগত দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একেবারে অন্যরকম বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া-বর্ধমান সীমান্তবর্তী দক্ষিণ দামোদর এলাকার মানুষ।

সাধারণভাবে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ওই এলাকার ইন্দাসের আকুই গ্রামের মানুষ যোগ দেন ‘সই-সাঙ্গাত’ পাতানোর উৎসব ‘সহেলা’-বর্তমানে যা লোক মুখে ‘সয়লা’তে রূপান্তরিত হয়েছে।

এবার ছ’বছর পর হয়েছে এই অনুষ্ঠান। আর সেকারণেই এখন আকুইয়ের প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের ভিড়, এমনকি দূর দূরান্ত থেকেও অসংখ্য মানুষ এই গ্রামে হাজির হয়েছেন ব্যতিক্রমী এই আয়োজনে অংশ নিতে।

সম্ভবত সই বা বন্ধুত্ব স্থাপনের আয়োজন বলেই অনুষ্ঠানের নাম সহেলা বা সয়লা হয়েছে বলে স্থানীয়দের অনেকে মনে করেন। কারণ এই শব্দটির মধ্যেই সখা-সই-সাঙ্গাত শব্দের উপস্থিতি রয়েছে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে মনসা পুজোর মাধ্যমে এই উৎসব পালিত হয়। গ্রামের সব বয়সের পুরুষ-মহিলা মনসার পুজো দিয়ে নিজেদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এখানে পুরুষের সঙ্গে পুরুষ ও নারীর সঙ্গে নারীর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। এখানে ধর্মের কোনও ভেদাভেদ থাকে না। সিরাজুদ্দিনের সঙ্গে মৃণাল ভট্টাচার্যের সয়লা স্থাপনে কোনও আপত্তি নেই। এটাই এই উৎসবের অন্যতম প্রাচীন রীতি। বর্তমান এই অস্থির সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য এক নজির হতে পারে আকুইয়ের এই সয়লা উৎসব।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সয়লার অন্যতম অঙ্গ হল ‘গোয়া চালানো’। গোয়া হলো সয়লার ঝাঁপি। এই ঝাঁপির মধ্যে দই, পঞ্চ শস্য, গোটা হলুদ, সিঁদুর, খই, গোটা সুপারি, পান বাতাসা রাখা থাকে। স্থানীয় চণ্ডী মন্দিরে পুজো দিয়ে পরস্পরের বাড়িতে এই ঝাঁপি নিয়ে স্থানীয়রা নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এ সময় পরস্পরকে শোলার মালা পরিয়ে, দইয়ের ফোঁটা দিয়ে, ‘উপরে খই নিচে দই, আমি তোমার চিরকালের সই’ লাইন দুটি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের সূচনা হয়।

আকুই গ্রামের বাসিন্দা বর্ষা কোনার এবং রিয়াস কোনার বলেন, ‘এই উৎসব আমাদের এলাকার প্রতিটি গ্রামের কাছে অত্যন্ত গর্বের। আমরা এই উৎসবের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করি।’ তারা আরও বলেন, ‘এই উৎসব এলেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পুরুষেরা পুরুষ বন্ধু এবং মহিলারা মহিলা বন্ধু খুঁজে সই পাতান। সেই সই সারা জীবন একে অপরের পাশে থাকার শপথ নেন। অনেকে পুরোনো বন্ধুকেই সই পাতিয়ে ঝালিয়ে নেন বন্ধুত্ব।’