যেভাবে নতুন সুনামির জন্ম দিলো পানামা পেপারস

দুনিয়ার প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং রাঘববোয়ালদের আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস করে সাড়া ফেলেছে আলোচিত ‘পানামা পেপারস লিক’। ফাঁস হওয়া এক কোটি ১৫ লাখ নথিতে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের সাবেক ও বর্তমান ৭২ জন রাষ্ট্রপ্রধান তাদের নিজ দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত। এখন পর্যন্ত এটিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ নথি ফাঁসের ঘটনা। এ নিয়ে এরইমধ্যে এক ধরনের সুনামি বয়ে গেছে বিশ্বের বহু দেশে। বিশেষ করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজনীতিকরা। এ ঘটনার জেরে এরইমধ্যে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে দেশটির পার্লামেন্টের বাইরে বিক্ষোভ করেছেন প্রায় ১০ হাজার বিক্ষোভকারী। আর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ নথিতে নাম থাকা অন্য বিশ্বনেতারা।

তবে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৭১ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় পেন্টাগনের ফটোকপি করা ও ফাঁস হওয়া নানা নথি। এরমধ্যে সাত হাজার পৃষ্ঠা ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কিত অতি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস। ওই সময় পর্যন্ত এটাই ছিল বিশ্বের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ নথি ফাঁসের ঘটনা। তখন যে পরিমাণ নিথ ফাঁস হয়েছিল এখনকার টেক্সট ফাইলের হিসাবে সেটা কয়েক ডজন মেগাবাইটে দাঁড়াবে। এর চার দশক পর ২০১০ সালে ক্যাবলগেট প্রকাশ করে আলোচিত ওয়েবসাইট উইকিলিকস। ওই সময়ে উইকিলিকস কর্তৃক প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

 তথ্য ফাঁসের ঘটনার নাম দেওয়া হয়েছিল ক্যাবলগেট। দুনিয়া কাঁপানো ওইসব তথ্য ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের। ডকুমেন্টের সংখ্যার দিক থেকে এটা ছিল ১ দশমিক ৭৩ গিগাবাইট। পূর্ববর্তী সবচেয়ে বড় ফাঁসের চেয়ে ডাটার ক্ষেত্রে এটা ছিল প্রায় শতগুণ বেশি।

উইকিলিকসের সেই ক্যাবলগেটের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় আবারও বড় আকারের ফাঁসের ঘটনা ঘটলো। যথারীতি এটাও এখন পর্যন্ত ইতিহাসের বৃহত্তম নথি ফাঁসের ঘটনা। এবার ফাঁস হওয়া ডাটার পরিমাণ ২ দশমিক ৬ টেরাবাইট। আগের ফাঁসের চেয়ে প্রায় হাজার গুণ বেশি।

গত রবিবার বিশ্বের শতাধিক শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় ফাঁস সম্প্রতি হওয়া পানামা পেপারস। ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেশন জার্নালিস্ট (আইসিআইজে)-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব নথি বিশ্বজুড়ে শতাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পানামাভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান মোস্যাক ফনসেকা এসব আর্থিক লেনদেনের বিষয় তদারকি করত। এই প্রতিষ্ঠানের তথ্যই ফাঁস হয়েছে।

মোস্যাক ফনসেকা’র ফাঁস হওয়া নথিতে উঠে এসেছে দুনিয়ার প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রের রাঘববোয়ালদের বিশাল অংকের কর ফাঁকির একটি পদ্ধতির কাহিনী। ফাঁসকৃত এসব নথির মধ্যে রয়েছে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ইমেইল, ৩ মিলিয়ন ডাটাবেজ ফাইল, ২ দশমিক ১ মিলিয়ন পিডিএফ ফাইল। ফাঁস হওয়া নথিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ প্রতিষ্ঠানটি তার গ্রাহকদের সম্পদ গোপনে সহায়তা করতো।

আইসিআইজে-এর পরিচালক গেরার্ড রিল বলেন, এগুলো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির গত ৪০ বছরের প্রাত্যহিক নথি। উইকিলিকস কর্তৃক প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের যে নথি ফাঁস হয়েছিল এটা তার চেয়ে প্রায় দুই হাজার গুণ বেশি। এটা ইতিহাসের সর্ববৃহৎ তথ্য ফাঁসের ঘটনা।

মোস্যাক ফনসেকা’র এসব ডাটা কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেশন জার্নালিস্ট অথবা কোনও রিপোর্টার ফাঁস করেননি। তবে তাদের প্রতিবেদন থেকে স্ক্যান্ডালের ডালপালা ছড়িয়েছে। এর ছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারেননি সেলিব্রিটি, অ্যাথলেট, বিজনেস এক্সিউটিভ ও বিশ্বনেতারা।

noname

নথিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২ বিলিয়ন ডলারের গোপন অর্থের কথা বলা হয়। তবে এতে সরাসরি পুতিনের নাম নেওয়া হয়নি। নথিতে মূলত পুতিনের পরিবারের সদস্য এবং তার ঘনিষ্ঠ সুরকার বন্ধু সের্গেই রোলদুগিন-এর নাম উঠে এসেছে। এছাড়া বিলিয়ন ডলার পাচারকারী একটি চক্রের সন্ধান মিলেছে, যা পরিচালিত হয় একটি রুশ ব্যাংকের মাধ্যমে। পুতিনের কয়েকজন ঘনিষ্ট সহযোগী এতে জড়িত। তবে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সম্মতি ব্যতীত এতো বড় কাজ তার ঘনিষ্ঠ লোক করতে পারেন না। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর ব্যাংক রোশিয়া নামের ওই ব্যাংকের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

ফাঁস হওয়া নথিতে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ডুর গুনলাউগসনের বিদেশে বিপুল সম্পদ থাকার কথা প্রকাশ হয়। এর প্রতিবাদে সিগমুন্ডুর গুনলাউগসনের অবিলম্বে পদত্যাগের দাবিতে দেশটিতে কয়েক হাজার প্রতিবাদকারী বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর নতুন সাধারণ নির্বাচনেরও দাবি জানিয়েছেন। একই দাবি জানিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পূর্বসূরিও।

এদিকে নথিতে যাদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ এসেছে তাদের বেশিরভাগই এই নথি প্রত্যাখ্যান করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে মস্কো। দেশটির কর্তৃপক্ষ এটাকে ‘মিথ্যার পরম্পরা’ বলে অভিহিত করেছে। আর ফুটবলের শীর্ষ সংস্থা ফিফার গভর্নিং বডি এটাকে ‘হাস্যকর’ বলেছে। আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, তিনি কোনও কর সুবিধা নেননি। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মাক্রির মুখপাত্র বলেছেন, প্রেসিডেন্টের নামে কখনও কোনও প্রতিষ্ঠান ছিল না। তবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও মেক্সিকো সম্ভাব্য কর ফাঁকির তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে।

/এমপি/