আসন্ন শীতে কি আরেকটি চীন-ভারত যুদ্ধ?

লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনা কমছেই না। মস্কোতে ১০ সেপ্টেম্বর চীন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে কিছু সমঝোতার পর সামরিক উত্তেজনা কমবে বলে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, তা দৃশ্যমান হচ্ছে না।  ওই বৈঠকের দু'সপ্তাহ পরও সীমান্তে উত্তেজনা কমার কোনও লক্ষণ নেই। দু’পক্ষের কেউই সৈন্য সরায়নি। বরং রসদ এবং সমরাস্ত্র জড়ো করার মাত্রা বেড়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধে জড়ানোর সব প্রস্তুতি রয়েছে উভয় দেশের। ফলে আসন্ন শীতে আরেকটি চীন-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা’র এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।

_114666117_whatsubject

মস্কোতে সমঝোতার পরও সীমান্তে গুলি করার অনুমোদন দেওয়াসহ ভারতের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য নিয়ে চীনের ভেতর ক্ষোভ এবং সন্দেহ তৈরির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ভারত-চীন উত্তেজনা: দিল্লিকে নিয়ে বেইজিংয়ের অনাস্থা-অবিশ্বাস-সন্দেহ বিপজ্জনক রূপ নিচ্ছে। চীনা সরকারের মুখ থেকে এখনও সরাসরি কিছু শোনা না গেলেও সরকারি মুখপাত্র বা সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সংবাদমাধ্যমে ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হিসেবে পরিচিতি ইংরেজি দৈনিক গ্লোবাল টাইমসে শনিবার তিন-তিনটি উপ-সম্পাদকীয়তে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ভারতকে নিয়ে চীনের মধ্যে অবিশ্বাস-অনাস্থা দিন দিন শক্ত হচ্ছে।

একটি উপ-সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল এমন, ‘কপট ভারতের ব্যাপারে শক্ত হওয়ার সময় এসেছে’। সাংহাইয়ের ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান লিউ জং ই তার ওই বিশ্লেষণে খোলাখুলি লিখেছেন, সীমান্ত সমস্যা সমাধানের কোনও সদিচ্ছা ভারতের নেই। তিনি লিখেছেন, ‘ভারতের মনোভাব এখন এমন যে তারা যা চায়, চীনকে তা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে।’

সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনে সোমবার সেনা কমান্ডার পর্যায়ে ষষ্ঠ দফা বৈঠকের পর ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দু উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে লেখে যে নিরাপত্তার প্রতি হুমকি মনে করলে এখন থেকে ভারতীয় সেনারা চীনা সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে দ্বিধা করবে না। চীনকে সে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।

হিন্দুর ওই প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে লিউ জং ই বলেছেন, ভারত প্রথম গুলি চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা এখন আর কোনোভাবেই নাকচ করা যায় না। চীনা এই বিশ্লেষক লেখেন, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ এখন কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ। সেই কট্টর অংশের কেউ কেউ এখন যুদ্ধের প্ররোচনা দিচ্ছেন।’

তিনি আরও লেখেন, ‘চীনকে এখনই শক্ত হতে হবে। এখনই যদি এর প্রতিকার চীন না করে, তাহলে মাঝে-মধ্যেই সীমান্তে সংঘাত নতুন একটি বাস্তবতা হয়ে দেখা দেবে।’

লিউ জং ই মনে করেন, চীনকে হটিয়ে বিশ্বে শিল্পপণ্যের প্রধান একটি সরবরাহকারী দেশ হওয়ার জন্য ভারতের ভেতর অদম্য আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে এবং সেজন্য চীনের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে ভারতের কোনও আগ্রহ নেই।

চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্ট্রাটেজিক ইনস্টিটিউটের গবেষক কিয়াং ফেং মনে করেন, চীনের ব্যাপারে নীতি নিয়ে ভারতের মধ্যে অব্যাহত অস্পষ্টতা, পরস্পর বিরোধিতার কারণে তাদের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় চীন এখন আর আস্থা রাখতে পারছে না।

শনিবার গ্লোবাল টাইমসে এক বিশ্লেষণে কিয়াং লিখেছেন, ‘ভারতে সরকারের মধ্যেই একেকজন একেক সময় একেক কথা বলছেন, পররাষ্ট্র দফতরের কথার সঙ্গে সেনা দফতরের কথার কোনও মিল নেই। অনেক সময় তাদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। সরকারের নীতির মধ্যে কোনও সমন্বয় নেই।’

এ প্রসঙ্গে চীনা ওই গবেষক উল্লেখ করেন, ১০ সেপ্টেম্বর দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি সমঝোতা করলেন, কিন্তু পরের দিন ভারতের প্রতিরক্ষা প্রধান বিপিন রাওয়াত বিবৃতি দিলেন সীমান্ত যেকোনও পরিস্থিতির জন্য ভারতীয় সেনারা প্রস্তুত।

ভারত অবশ্য সব সময় বলছে যে সীমান্ত পরিস্থিতির দায় একমাত্র চীনের। চীনই এখানে আগ্রাসীর ভূমিকায় এবং ভারত শুধু তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করছে।

_114665970_73ec995d-67e6-4117-8c10-88c23a260aca

কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, চীন ও ভারতের মধ্যে অনাস্থা এবং অবিশ্বাসের মাত্রা এখন এতই প্রবল হয়ে উঠছে যে কথাবার্তা চালিয়ে তেমন কাজ হচ্ছে না। চীনের ভেতর আশঙ্কা বাড়ছে যে ভারত হয়তো একটি যুদ্ধ চাইছে। ভারতকে তারা এখন একেবারেই বিশ্বাস করছে না।

ড. আলী মনে করেন, ১৯৮৮ সালে প্রয়াত রাজীব গান্ধীর বেইজিং সফরের পর গত ৩০ বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে অব্যাহতভাবে যে স্থিতিশীলতা চলছিল, তা একের পর এক ভেঙে পড়ছে। তিনি বলেন, সীমান্তে রক্তপাতের বিরুদ্ধে যে মনস্তাত্ত্বিক বাধা ছিল, জুন মাসে তা ভেঙে পড়েছে। সীমান্তে গুলি ব্যবহারের বিরুদ্ধে যে মনস্তাত্ত্বিক বাধা ছিল তাও ভেঙে পড়েছে। কারণ গত দুই মাসে দুই পক্ষ কমপক্ষে তিনবার ফাঁকা গুলি ছুড়েছে।

ড. আলী বলেন, ‘এখন যদি ভারতীয়রা তাদের দেওয়া হুমকি মতো চীনা সেনাদের দিকে গুলি ছুড়ে বসে, তাতে আমি অবাক হবো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে বিশেষ করে লাদাখ সীমান্তে ভারত যেভাবে ধীরে ধীরে অবকাঠামো গড়ে তুলছে, সেটাকে চীন ১৯৮৮-তে করা সমঝোতার বরখেলাপ হিসাবে বিবেচনা করে। সত্যি কথা বলতে কী, বর্তমান সংকটের শুরু সেটা নিয়েই।’

পাশাপাশি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিক এবং রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বেইজিংকে ভারতের ব্যাপারে আরও সন্দিহান করে তুলেছে। ড. মাহমুদ আলী বলেন, গত বেশ কিছু দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিষয়ক নীতিনির্ধারকের মধ্যে একটি বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে যে চীনকে রুখতে যদি কোনও যুদ্ধ করতেই হয়, তাহলে এখনই করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘তারা মনে করছেন আরও আট-দশ বছর দেরি হলে সেটা আর হয়তো কখনোই সম্ভব নাও হতে পারে। আমি মনে করি ভারতও হয়তো এখন তেমনটাই ভাবছে। তারাও হয়তো ভাবছে, যদি কখনও চীনের সঙ্গে সংঘাতে যেতেই হয়, এখনই মোক্ষম সময়। কারণ, ভারত জানে চীনের শত্রুদের কাছ থেকে তারা সাহায্য পাবে।’

ড. আলী বলেন, এর ফলে চীনও ভাবছে তাদেরও এখন ব্যবস্থা নিতেই হবে। তাদের কাছে তেমন কোনও বিকল্প এখন আর নেই।’

_114665964_whatsubject

এমন পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে প্রকাশ্যে যত আলোচনাই হোক কেন, তাতে বিপদ কমছে বা কমবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন না। তার ইঙ্গিতও স্পষ্ট।

প্রতি বছরই শীতের সময় অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত লাদাখে দুই দেশের সেনারা পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসে। কিন্তু ভারত এবার জানিয়ে দিয়েছে এই শীতে সেনারা পাহাড়েই থাকবে। ভারত সেটা করলে চীনকেও একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ড. আলী মনে করেন, দু'পক্ষই সম্ভাব্য একটি সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

চীনা সামরিক বিশেষজ্ঞ সং ঝং পিং শনিবার গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, কোভিড মহামারিসহ তাদের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য সংকটের কারণে চীনের সঙ্গে একটি যুদ্ধের জন্য ভারত যেকোনও সময় উসকানি তৈরি করতে পারে।

তিনি আরও মনে করিয়ে দেন, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল শীতকালে। এবারের শীতেও তেমনটি যে হবে না, সে আশঙ্কা তিনি নাকচ করেননি।