তালেবান শাসনে নিজেদের যেভাবে মানিয়ে নিচ্ছে আফগানরা

উত্তর আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফের বলখ এয়ারফিল্ড। সেখানে নামছে রুশ নির্মিত  একটি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার। তালেবান যোদ্ধারা বেশ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে সেটির ছবি তুলছেন। হেলিকপ্টারটির আরোহীদের মধ্যে আছেন ঊর্ধ্বতন তালেবান কর্মকর্তারা। তবে ককপিটে চালকের আসনে বসে আছেন তাদের সাবেক শত্রু আফগান বিমান বাহিনীর পাইলট।

মৌলভী আবদুল্লাহ মনসুর হচ্ছেন এই এয়ারফিল্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত তালেবান অধিনায়ক। সেখানে তার অধীনে এখন যেসব বিমান ও সামরিক সরঞ্জাম, তিনি সেগুলো বিবিসি-র সাংবাদিক সেকান্দার কেরমানিকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাহিনী আফগানিস্তানের সাবেক সরকারকে এগুলো উপহার দিয়েছিল। এর মধ্যে আছে যুদ্ধ বিমান, আছে হামলা চালানোর মতো সামরিক হেলিকপ্টার।

আফগানিস্তানের সাবেক সরকারের আমলে এসব বিমান ও হেলিকপ্টার দিয়েই তালেবানের বিরুদ্ধে হামলা চালানো হতো। কিন্তু এখন যুদ্ধ যেহেতু শেষ। তাই এগুলো এখন কী কাজে ব্যবহৃত হবে তা স্পষ্ট নয়।আবদুল্লাহ মনসুর অবশ্য বলছেন, ‘ভবিষ্যতে যদি দরকার হয়, এগুলো আমাদের হাতে আছে।‌‌’

২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিতে সমর্থ হয় তালেবান। এর কিছুদিন আগে থেকেই যখন দলটি আফগানিস্তানজুড়ে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রেখেছিল, তখন আফগান বিমান বাহিনীর কয়েক ডজন পাইলট প্রাণভয়ে বিমান নিয়ে পালিয়ে যান। তবে অনেকেই আফগানিস্তানে থেকে যান। এখন তারা তালেবান নেতৃত্বের অধীনেই কাজ করছে। তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিবিসি মৌলভী মনসুরের কাছে জানতে চেয়েছিল, যে শত্রুর বিরুদ্ধে তিনি একটা সময় লড়াই করেছেন, এখন তার সঙ্গেই কাজ করতে তার কেমন লাগছে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের মনে সবসময় এই বিশ্বাস ছিল যে জয় আমাদের হবেই এবং আমরা আমাদের দেশকে মুক্ত করবো। কিন্তু আমরা এটাও জানতাম যে একদিন সকালে আমাদের একসঙ্গে বসতে হবে এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। কারণ তারাও তো আমাদের দেশেরই মানুষ।’

মৌলভী মনসুরের পাশে বসে আছেন হেলিকপ্টার পাইলট গুল রহমান। তিনি জবাব দিচ্ছিলেন বেশ সতর্কতার সঙ্গে। জানালেন, যখন তিনি তালেবানের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা শুনলেন, তখন আর  কাজে ফিরতে তার ভয় করেনি। তবে আফগানিস্তানে ক্ষমতার এমন পালাবদল অবশ্যম্ভাবী ছিল বলে মনে করেন তিনি।

গুল রহমানের ভাষায়, ‌‘আমাদের কখনোই মনে হয়নি চিরকাল আমাদের এমন আলাদা পথে চলতে হবে। আমরা রাজনীতিটা রাজনীতিকদের কাছেই ছেড়ে দিতে চাই এবং দেশের উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করতে চাই।’

তরুণ তালেবান যোদ্ধারা এয়ারফিল্ডের হ্যাঙ্গারের আশেপাশে জটলা করছিল। তারা কৌতুহলের সঙ্গে দেখছিল দুইটি এমডি-৫৩০ হেলিকপ্টার। একজন তালেব যখন একজন মেকানিককে তার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করছিল, তখন সেখানে একটা চাপা উত্তেজনা টের পাওয়া গেলো।

অভিযোগের সুরে এই তালেব বলছিলেন, ‘তুমি এই চাকুরি পেয়েছো তোমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং যোগাযোগের কারণে, তোমার যোগ্যতার কারণে নয়।’ তবে এ রকম কথাবার্তা সত্ত্বেও সেখানে একটা সৌহার্দ্যের পরিবেশই আছে বলে মনে হয়েছে।

আফগানিস্তানের পুরোনো শাসনামল থেকে নতুন শাসনামলে উত্তরণের ব্যাপারটি সব জায়গায় অবশ্য এতোটা মসৃণভাবে ঘটছে না। দেশটি এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে। তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কিভাবে তালেবানকে বাদ দিয়ে আফগানদের সাহায্য করা যায়।

আফগানিস্তানে ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর সামনে লম্বা লাইন। বিভিন্ন শহরে এখন পুরোনো জিনিসপত্রের বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আফগানরা মরিয়া হয়ে সংসারের পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করছে, যাতে অন্তত খাদ্য কেনার টাকা পাওয়া যায়।

শাগুফতা নামের এক নারী রাস্তার ধারে বসেছিলেন। ঘর থেকে বিক্রির জন্য আনা পুরোনো কাপড়-চোপড় হাতড়াচ্ছিলেন। অশ্রুসজল চোখে তিনি বললেন, ‘এখন বেঁচে থাকাটাই যেন এক ধরনের অপমান, আমরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছি।’

শাগুফতার শরীর বেশ দুর্বল, কারণ সকালে তিনি নাস্তা করেননি। আগের রাতেও কোনও খাবার জোটেনি। বললেন, ‌‘খাবার যা ছিল, তা বাচ্চাদের দিয়েছি। এখন আমি তাদের ভালো কাপড়-চোপড়গুলোও বিক্রি করে দিচ্ছি। কোনও বিয়ের অনুষ্ঠানে ওরা যেসব পোশাক পরে যেতো, যদি ভালো দাম পাই তাহলে সেই অর্থ দিয়ে তেল, চাল ও আটা কিনবো।’ শাগুফতার গল্প আফগানিস্তানে যে গভীর বৈষম্য, সেটাকেই যেন তুলে ধরছে।

এই নারী বলেন, ‘ইসলামিক আমিরাত ভালো। কারণ এখন চুরি বন্ধ। কোনও অপরাধ আর  ঘটছে না। কিন্তু আমাদের সমস্যা একটাই। আমাদের কোনও কাজ নেই, আমাদের হাতে কোন টাকা নেই।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা।