সামরিক অভ্যুত্থানের এক বছরেও শান্তি নেই মিয়ানমারে

এক বছর আগে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান শুধু যে নির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে তা নয়, এর ফলে দেশটিতে অবাক করার মতো জনগণের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। যা এখন নিম্ন মাত্রায় থাকলেও ধারাবাহিক সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়েছে।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের নেত্রী সু চি, সরকার ও ক্ষমতাসীন এনএলডি দলের শীর্ষনেতাদের গ্রেফতার করে ক্ষমতা দখল করেন সেনাবাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেয়েছিল সু চির দল।

অভ্যুত্থানের পর জান্তাবিরোধী গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ দমন করা হয় কঠোর হাতে। সহিংসতা এমন মাত্রায় গড়ায় যে অনেক বিশ্লেষক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে গড়াচ্ছে বলে উল্লেখ করতে শুরু করেন। সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে বিক্ষোভকারীদের। স্থানীয় একটি পর্যবেক্ষক সংস্থার মতে, এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত হয়েছে নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে, আটক করা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮০০ জনকে। এছাড়া অজ্ঞাত সংখ্যক নিপীড়ন ও গুমের শিকার হয়েছে। প্রতিরোধের শেকড় উচ্ছেদ একাধিক গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে ৩ লক্ষাধিক মানুষ।

সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের অপর পরিণতিগুলোও ছিল উল্লেখযোগ্য। জান্তার বিরুদ্ধে অসহযোগিতা আন্দোলনে প্রভাব পড়েছে পরিবহন, ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থায়, করোনায় বিধ্বস্ত অর্থনীতি হয়েছে আরও মন্থর। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কয়েক মাস করোনার বিরুদ্ধে লড়াই ছিল পরিত্যক্ত। বিক্ষোভের প্রতি সহানুভুতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্লাস বয়কট বা গ্রেফতার হওয়ার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে উচ্চ শিক্ষা।

জান্তা প্রধান জেনারেল অং মিন হ্লাইং

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশ্লেষক থমাস কিয়ান জানান, যে মাত্রায় প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে তা সেনাবাহিনীর গঠিত সরকারের ধারণায় ছিল না।

‘অভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েকদিন আমরা দেখেছি তারা সাধারণভাবে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছে। বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন বাস্তবায়নের কথা অস্বীকার করেছেন জেনারেলরা, তারা দাবি করেছেন শুধু সু চিকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে,’ বলেন থমাস কিয়ান।

তিনি আরও বলেন, ‘এবং এর ফলে বিশাল বিক্ষোভের জন্ম হয়েছে। যা নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। এতে করে মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছে।’

বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী গ্রামীণ এলাকাগুলোতে একই নির্মম কৌশল প্রয়োগ করেছে যা সংখ্যালঘুদের ওপর সীমান্ত এলাকায় করা হতো। এর ফলে সমালোচকরা তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী ও গণহত্যার অভিযোগ আনছেন।

জান্তার দমন এড়াতে শহুরে বিক্ষোভ তাৎক্ষণিকতায় পরিণত হয়। তবে গ্রামীণ তা এলাকাগুলোতে সংঘাতে পরিণত হয়। স্থানীয় মিলিশিয়ারা গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছে।

অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয় সু চির বিচার চলছে জান্তার আদালতে

বিশ্লেষক কিয়ান বলেন, যখন সেনাবাহিনী কোনও গ্রামে প্রবেশ করে তখন তারা কিছু বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, হয়ত কিছু মানুষকে গুলি করে, কয়েকজনকে বন্দি বা নির্যাতন করে। কিন্তু যখন সেনারা চলে যায় তখন তারা ওই গ্রামের নিয়ন্ত্রণ হারায়। বিরুদ্ধভাবাপন্ন ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো জনবল নেই তাদের।

কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক দফতরের প্রধান পাদোহ সাউ টাউ নি বলেন, যে কোনও কারণেই হোক না কেন আমরা কোনও অভ্যুত্থান কখনও মেনে নেইনি। আমাদের সংগঠনের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট। আমরা সামরিক স্বৈরাচারের বিরোধিতা করি। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেনাবাহিনীর বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে আমরা কাজ করছি।

কিয়ানের মতে, কীভাবে এই সংঘাতের অবসান হবে তা ধারণা করা মুশকিল। হয়ত কিছুদিনের মধ্যে অথবা কয়েক বছর লাগতে পারে। মিয়ানমারের কিছু অঞ্চলে শান্তি ফিরেছে, এমন কল্পনা করাও এই মুহূর্তে কঠিন।

সূত্র: এপি