অনুপস্থিত শি-পুতিন, ঐকমত্য ছাড়া শেষ হবে জি-২০ সম্মেলন?

ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে বিভাজন, খাদ্য নিরাপত্তা, ঋণ সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বৈশ্বিক সহযোগিতার মতো বিষয়ে অগ্রগতি হ্রাস হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে নয়াদিল্লিতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলো জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হবে।

যুদ্ধের বিষয়ে কঠোর অবস্থান থাকায় এই বছর ভারতের সভাপতিত্বে জি-২০-এর ২০ বা তার বেশি মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ঐকমত্য দেখা যায়নি। সম্ভাব্য ঐকমত্যের পথ খুঁজে বের করার দায়িত্ব নেতাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট নয়, আসন্ন সম্মেলনে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করবেন প্রিমিয়ার লি কিয়াং। রাশিয়াও নিশ্চিত করেছে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অনুপস্থিত থাকবেন। ফলে সম্মেলনে কোনও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা খুব বেশি নেই।

৯ সেপ্টেম্বর থেকে দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনে পশ্চিমা ও তার মিত্রদের আধিপত্য থাকবে। জি-২০ নেতাদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং জাপানের ফুমিও কিশিদা উপস্থিত থাকবেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্ভাব্য ব্যর্থ শীর্ষ সম্মেলনে পাশ্চাত্য এবং পূর্বের শক্তিগুলোর মধ্যে সহযোগিতার সীমারেখা প্রকাশ্যে আসবে। দেশগুলো যে গোষ্ঠীর সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করতে প্ররোচিত করবে।

একটি ঐকমত্য তৈরি করতে ব্যর্থ হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কূটনৈতিক সফলতার দাবি ক্ষুণ্ন হবে, যিনি ভারতের সভাপতিত্ব পদকে ব্যবহার করছেন অর্থনৈতিক শক্তি এবং গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসেবে নয়াদিল্লির অবস্থানকে শক্তিশালী করতে৷

ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, নেতাদের সম্মেলন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে নয়াদিল্লি এবং বিশেষ করে মোদি একটি বড় কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করেনি ভারত। সম্মেলনে ঐকমত্য অর্জনে দেশটিকে একটি যৌথ বিবৃতিতে সম্মত হতে হবে। অথবা ২০০৮ সালের পর প্রথমবার নেতাদের এমন কোনও যৌথ ঘোষণা ছাড়াই জি-২০ এর সম্মেলন শেষ  হবে। 

শেষ মুহূর্তে পাল্টাবে পরিস্থিতি?

ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের শীর্ষ সম্মেলনের কথা উল্লেখ করে ভারতের একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, বালি শীর্ষ সম্মেলনের পর থেকে বিভিন্ন দেশের অবস্থানগুলো কঠোর হয়েছে। রাশিয়া ও চীন তখন থেকে তাদের অবস্থান কঠোর করেছে, ফলে একটি ঐকমত্য অর্জন খুব কঠিন হবে।

বালিতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো শেষ মুহূর্তে একটি যৌথ বিবৃতিতে নেতাদের রাজি করাতে পেরেছিলেন। অপর এক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, ভারত আশা করছে নেতারা আবার শেষ মুহূর্তে এমন কিছু করতে পারেন।

বালি নেতাদের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, বেশিরভাগ সদস্যই ইউক্রেনের যুদ্ধের তীব্র নিন্দা করেছে এবং জোর দিয়ে বলা হয়েছিল এটি বিপুল মানবিক দুর্ভোগের কারণ এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদ্যমান ভঙ্গুরতাকে বাড়িয়ে তুলছে।

এতে আরও বলা হয়েছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মতামত ও পরিস্থিতি এবং নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বিভিন্ন  দেশের ভিন্ন মূল্যায়ন ছিল।

অপর একজন ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছেন, বালিতে রাশিয়া এবং চীন আরও নমনীয় ছিল। কিন্তু যুদ্ধের ১৮ মাস পূর্ণ হওয়ার পর দেশগুলো এমনকি বালি ঘোষণায় ব্যবহৃত ভাষা ব্যবহারে একমত হচ্ছে না।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং পুতিনের বদলে সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করা রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ইতোমধ্যে বিভক্তি তুলে ধরেছেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপে ভারতে সম্মেলনে অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার সময় ট্রুডো বলেছিলেন, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ না করায় তিনি হতাশ।

ট্রুডো বলেছিলেন, আপনি জানেন, আমরা আপনার পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলব এবং  বিশ্ব যে ইউক্রেনের পাশে আছে তা আমরা নিশ্চিত করা অব্যাহত রাখব।

ল্যাভরভ গত সপ্তাহে বলেছিলেন, রাশিয়া জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণাকে ঠেকিয়ে দেবে যদি এতে কিয়েভ ও অন্যান্য সংকটের বিষয়ে মস্কোর অবস্থানের প্রতিফলন না থাকে।

কূটনীতিকরা বলেছেন, মস্কোর অবস্থানের কোনও গ্রহণযোগ্যতা একেবারে অসম্ভব। 

চীন ব্রিকসকে সামনে আনছে? 

গত মাসে ব্রিকস গ্রুপের সম্প্রসারণে ছয়টি দেশকে সদস্য হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই গ্রুপে চীন একটি প্রভাবশালী দেশ। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থাকে পুরনো উল্লেখ করে এতে রদবদল আনার লক্ষ্য রয়েছে বেইজিংয়ের।

পরামর্শক সংস্থা ইউরেশিয়া গ্রুপের পরিচালক ডেভিড বোলিং বলেছেন, শি জিনপিংয়ের অনুপস্থিতি জি-২০ এর কফিনে পেরেক ঠুকতে বেইজিংয়ের প্রচেষ্টা হতে পারে, ব্রিকসকে সম্প্রসারণের কয়েক সপ্তাহ পরে সম্মেলনে হাজির হচ্ছেন না তিনি। ব্রিকস চীনের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আরও বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ভারত ব্রিকসের সদস্য। এর সম্প্রসারণ নিয়ে সম্মেলনের আগে কিছুটা উদ্বেগ ছিল দেশটির। কিন্তু গত মাসে জোহানেসবার্গে শীর্ষ সম্মেলনে নতুন সদস্যদের জন্য মানদণ্ডের বিষয়ে ঐকমত্য হয় তারা।

ভারত নিজের জি-২০ সভাপতিত্বকে ইউক্রেন নিয়ে মতপার্থক্যগুলোকে বাদ দিয়ে রেখে জলবায়ু পরিবর্তন, দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ঋণ, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং বহুপাক্ষিক ব্যাংক সংস্কার সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ দিচ্ছে। কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনীয় শস্য রফতানির অচলাবস্থাও ভাঙতে চায় ভারত। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরিকল্পনার বিরোধিতা থেকে রাশিয়ার সরে আসার সম্ভাবনা নেই।

সূত্র: রয়টার্স