এবার কি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবে চীন?

আট বছর আগে হোয়াইট হাউজের ক্ষমতায় এসে ঝড় তুলেছিলেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতায় বসেই চীনের ওপর শুল্কের আরোপ করেন তিনি। দেন উত্তপ্ত বক্তৃতাও। অবশ্য তার এমন আচরণের জবাবও দিয়েছেন ক্ষুব্ধ চীনা নেতারা। ফলে বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতির মধ্যে একটি বাণিজ্য যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা দুদেশের সম্পর্ককে বহু বছরের মধ্যে একেবারে তলানিতে ঠেকায়।

একটি নাটকীয় ও ঐতিহাসিক জয়ের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প আবারও যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসতে যাচ্ছেন। ক্ষমতায় আসার আগেই চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্কা আরোপের পরিকল্পনা করেন তিনি।

রয়টার্স বলছে, ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেইজিং এবার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে। আত্মনির্ভরশীলতা বাড়িয়ে প্রযুক্তিতে। এছাড়া ইতোমধ্যে নতুন শুল্ক আরোপের মার্কিন হুমকির মুখে থাকা আরও ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে আলাদাভাবে অর্থ রিজার্ভে করে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, চীনকে একটি প্রযুক্তিগত পরাশক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই বিজয় তার এই পরিকল্পনার গুড়েবালি দেবে।

করোনা মহামারির পর অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে চীন। এরপর থেকেই দেশটিতে সম্পত্তির মূল্যে মন্দা, সরকারের ঋণ, বেকারত্ব বৃদ্ধি শুরু হয়, যা এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মন্থর করে দিয়েছে।

প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এবার এর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করেছেন তিনি। তবে এমন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত বলে মনে করেন চীন বিশ্লেষক বিল বিশপ।

তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প যখন শুল্ক নিয়ে কথা বলেন, তার কথায় বোঝা যায়, তিনি মনে করেন চীন বাণিজ্য চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এমনকি ২০২০ সালের নির্বাচনে তার পরাজয়ের অন্যতম কারণ চীন ও কোভিড।’

২০২১ সালে হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করেন ট্রাম্প। তবে তিনি হোয়াইট হাইজ ত্যাগ করলেও চীনের ওপর চাপ কমায়নি ওয়াশিংটন। ট্রাম্পের নেওয়া পদক্ষেপগুলো বাইডেন প্রশাসনও অব্যাহত রেখেছিল। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তা আরও প্রসারিতও করেছিল।

দুই বছর আগে, বিশ্বে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত কঠোর বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর, অর্থনীতিকে মহামারি পূর্ববর্তী প্রবৃদ্ধির স্তরে ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে চীন। তবে সে চেষ্টা সফলতার মুখ দেখছে না।

গত সেপ্টেম্বরে, দেশটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া কমিয়ে দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

চীনের অর্থনীতি ২০২৪ সালে চার দশমিক আট শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল আইএমএফ। পরবর্তীতে চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি আরও কমে চার দশমিক পাঁচ শতাংশে পৌঁছাবে বলে অনুমান করে তারা।

২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, চীন ‘দ্রুত প্রবৃদ্ধি থেকে উচ্চমানের উন্নয়নের পর্যায়ে’ যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, শুধু রফতানি করেই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না চীন। মর্গান স্ট্যানলি এশিয়া’র সাবেক চেয়ারম্যান স্টিফেন রোচ সতর্ক করে বলেন, সতর্ক না হলে চীনকে জাপানের মতো কয়েক দশকের দীর্ঘ স্থবির পরিণতি ভোগ করতে হবে।

রোচ আরও বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি এড়াতে চীনকে নতুন শ্রেণির ভোক্তা চাহিদার ওপর নজর দিতে হবে এবং রফতানি ও বিনিয়োগ-নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধি থেকে সরে আসতে হবে।’

তিনি বলেন, এই পদক্ষেপ শুধু টেকসই প্রবৃদ্ধিকেই উৎসাহিত করবে না, বরং ‘বাণিজ্যিক উত্তেজনা এবং বিদেশে চীনা অর্থনীতির ঝুঁকি কমাতে’ সাহায্য করবে।

দ্বিতীয় দফায় ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফিরে আসার মধ্য দিয়ে চীনের ওপর যে হুমকি তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলা করতে এই ধরনের আরও শক্তিশালী অর্থনৈতিক মডেল চীনকে সাহায্য করতে পারে।

নতুন অর্থনীতি, পুরনো সমস্যা

দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বব্যাপী কম খরচে পণ্য তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত চীন। এখন উচ্চ প্রযুক্তির রফতানির মাধ্যমে সেই পরিচিতিকে পুনরায় অর্জনের চেষ্টা করছে দেশটি। সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ চীন।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ)-এর তথ্যমতে, সৌর প্যানেল উৎপাদনে এখন অন্তত ৮০ শতাংশের অংশীদার চীন।

আইইএ বলেছিল, গত বছর গ্রিন এনার্জিতে বিশ্বের মোট বিনিয়োগের এক-তৃতীয়াংশই ছিল চীনের। কারণ ‘নবায়নযোগ্য শক্তিতে সক্ষমতা বাড়াতে অব্যাহতভাবে অসাধারণ অগ্রগতি’ করেছে দেশটি।

লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউজের সিনিয়র গবেষক ডেভিড লুবিন বলেন, ‘উচ্চ-প্রযুক্তি ম্যানুফ্যাকচারিংকে সমর্থনের জন্য নিশ্চিতভাবেই চীনে একটি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে।’ আর তাদের এই প্রচেষ্টা ‘বেশ সফলও হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

২০২৩ সালে বৈদ্যুতিক গাড়ি, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ও সৌর প্যানেলের রফতানি ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা এক ট্রিলিয়ন ইয়ান বা ১৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক আধিপত্য বৃদ্ধিতে চীনকে এই শিল্পগুলো সাহায্য করেছে।

এই রফতানি বৃদ্ধির কারণে চীনের অর্থনীতিতে চলমান সম্পত্তি সংকটের আঘাত কিছুটা হলেও কমেছে।

ন্যাটিক্সিস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, ‘চীনের অতিরিক্ত ক্ষমতা যে বাড়বে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাদের প্রবৃদ্ধির আর কোনও উৎসও নেই।’

তবে ওই রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরোধও বেড়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, গত মাসে চীনে নির্মিত বৈদ্যুতিক গাড়িতে শুল্ক ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

মুডি'স অ্যানালিটিক্সের রিসার্চ ডিরেক্টর ক্যাটরিনা এল বলেন, ‘এখনকার সমস্যা হলো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় গ্রাহকরা সেই পণ্যগুলো নিতে ক্রমশ অনীহা প্রকাশ করছে।’

আজ যখন ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতা ও দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং চীনা রফতানিকে কোণঠাসা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সম্প্রতি তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো আদৌ যথেষ্ট কিনা, বেইজিংকে তা ভাবতে হবে।