ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: শান্তি এলেও ঝুঁকি কাটেনি

চার দিনব্যাপী এক উত্তাল সামরিক সংঘাতের পর ভারত ও পাকিস্তান ফের একবার সীমান্ত যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু এবারকার সংঘর্ষে প্রযুক্তির নতুন মাত্রা, একে অপরের প্রতি অনমনীয় রাজনৈতিক অবস্থান এবং গভীর জাতীয়তাবাদ ভবিষ্যতে আরও ঘন ঘন সংঘাতের শঙ্কা তৈরি করেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।

সাম্প্রতিক এই সংঘাতে উভয় পক্ষই আধুনিক ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে একে অপরের অভ্যন্তরীণ সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। শত শত ড্রোন কাশ্মীর সীমান্তে একসঙ্গে উড়েছে, পরীক্ষায় ফেলেছে একে অপরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—তাতে পাইলটের কোনও ঝুঁকি না থাকলেও, রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছেছে।

যুদ্ধ যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, এমন এক সময়ে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। অতীতে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত থামাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো এবার অনেক দেরিতে, প্রায় শেষ মুহূর্তে নড়েচড়ে বসে।

সামরিক ইতিহাসবিদ ও কৌশল বিশ্লেষক শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারত-পাকিস্তান অধিকাংশ বড় সংঘাত থেমেছে বাইরের হস্তক্ষেপে।

তার মতে, উভয় দেশেরই সামরিক উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কম, ফলে বিদেশি অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুমকি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

রাঘবন বলেন, এবার দুইপক্ষের অবস্থান ছিল আরও কঠিন। বিশেষ করে ভারত মনে করছে, পাকিস্তানকে এমন বার্তা দিতে হবে যেন তারা মনে না করে সহজে পার পেয়ে গেছে।

তিনি মনে করেন, দুই দেশই এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখানে কেউ চাইছে না পরবর্তী যুদ্ধের ফলাফল অন্যপক্ষের পক্ষে চলে যাক।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কেবল সীমান্তে সীমাবদ্ধ নয়, দুই দেশেই কট্টর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ রাজনীতিকে চালিত করছে। পাকিস্তানে এক কট্টরপন্থি সামরিক নেতৃত্ব ইসলামীকরণে বিশ্বাসী, অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার হিন্দু জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বদলে দিচ্ছে।

এই রাজনৈতিক বাস্তবতা দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বরফ না গলানোর অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পরেও দুই দেশ ভিসা নিষেধাজ্ঞা সহজ করেনি, আবারও সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের হুমকি পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে বিবেচিত হচ্ছে।

গত ২২ এপ্রিল ভারতীয় কাশ্মীরে এক জঙ্গি হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে এর জন্য দায়ী করে, যদিও পাকিস্তান তা অস্বীকার করে।

এই ঘটনায় ২০১৬ ও ২০১৯ সালের মতোই ভারত প্রতিক্রিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ব্যাপক সামরিক প্রতিশোধ নেয়। মোদি সরকার গত ছয় বছরে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে এনে কূটনৈতিকভাবে আলাদা রাখার নীতি অনুসরণ করছিল। একইসঙ্গে কাশ্মীর সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করে ব্যাপক সামরিকায়ন করা হয়েছে।

এই সংঘর্ষে প্রথমবারের মতো শত শত অস্ত্রসজ্জিত ড্রোন একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। কাশ্মীর সীমান্তের উভয় পাশে আকাশ ভরে যায় হামলাকারী ড্রোনে, যারা কোনও পাইলট ছাড়াই প্রতিপক্ষের ভূখণ্ডের গভীরে ঢুকে হামলা চালায়। একপর্যায়ে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সামরিক ঘাঁটি, বিমানঘাঁটি ও রাডার স্থাপনায় সরাসরি আঘাত হানে। এই অবস্থায় দুই দেশের সামরিক বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে চলে যায়।

২০১৯ সালের সংঘর্ষে ভারত একটি হেলিকপ্টার হারায় এবং পাকিস্তান একটি পুরোনো ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে নামায়। সেই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে মোদি সরকার সামরিক আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেয়, তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্ত্র সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে।

এবার ভারত প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে আরও সুসংগঠিতভাবে। বুধবার শুরু হওয়া আক্রমণে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গভীর লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। এসব লক্ষ্য ছিল সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঘাঁটি।

সরকারিভাবে উভয় পক্ষই প্রতিদিন শান্তির কথা বললেও রাত হলেই আবারও শুরু হয় গোলাবর্ষণ, ড্রোন হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। ক্রমেই হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে উভয় দেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল সামরিক ও কৌশলগত স্থাপনা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি দেখে স্পষ্ট, কৌশলগত বা পরিচালনাগত দিক থেকে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। বরং, দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের এই ধরনের উত্তেজনা যদি ফের মাথাচাড়া দেয়, তাহলে এর পরিণতি অনেক বেশি ভয়াবহ হতে পারে।

শেষ পর্যন্ত সংঘাতের পঞ্চম দিনে—শনিবার গভীর রাতে—যখন দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য লক্ষ্যে হামলা শুরু হয়, তখন কূটনৈতিক চাপ কার্যকর হতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সরাসরি তৎপরতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

যদিও আপাতত যুদ্ধ থেমেছে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংঘাত হয়তো পাকিস্তানের জন্য নতুন একটি সতর্কবার্তা। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, বড় ধরনের কৌশলগত সুবিধা কেউ পায়নি।

ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ভি পি মালিক বলেন, আমরা ভারতের ভবিষ্যতের ইতিহাসের হাতে ছেড়ে দিলাম—এই সংঘাতের মাধ্যমে আমরা আদৌ কোনও রাজনৈতিক বা কৌশলগত লাভ করেছি কিনা। সেটি ভবিষ্যৎই বলবে।