ফিনল্যান্ড, সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান কেন বড় ঘটনা?

যেকোনও সময়ে এটি ন্যাটোর দ্রুততম সম্প্রসারণের ঘটনা এবং যা ইউরোপের নিরাপত্তা মানচিত্রকে নতুনভাবে তৈরি করতে পারে। বৃহস্পতিবার ফিনিশ নেতারা জানিয়েছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে ফিনল্যান্ড বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক জোট ন্যাটোতে ‘কোনও বিলম্ব না করে’ যোগদান করবে। সুইডেন তাদের পথ অনুসরণ করতে পারে।

দেশ দুটি সদস্যপদের জন্য আবেদন করলে তা উত্তর ইউরোপ ও ট্রান্স-আটলান্টিক নিরাপত্তা ছাড়িয়ে সুদূর প্রভাব ফেলবে। কোনও সন্দেহ নেই এতে তাদের বৃহৎ প্রতিবেশী রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করবে। ইউক্রেনে যুদ্ধের একটি কারণ হিসেবে মস্কো তাদের সীমান্তে ন্যাটোর চলমান সম্প্রসারণকে হাজির করছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কেমন পাল্টা পদক্ষেপ নেবেন তা স্পষ্ট নয়। বৃহস্পতিবার ক্রেমলিন জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত নিশ্চতভাবে ইউরোপের নিরাপত্তার উন্নতি ঘটাবে না।

৩০ সদস্য রাষ্ট্রের ন্যাটো জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সদস্য হওয়াটা কেন গুরুত্বপূর্ণ তা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে মার্কিন বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)। 

সুইজারল্যান্ডের মতো নিরপেক্ষ নয়, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন চিরাচরিতভাবে নিজেদের সামরিকভাবে ‘জোট নিরপেক্ষ’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছিল। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ এবং মস্কোকেন্দ্রিক প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে পুতিনের আকাঙ্ক্ষা দেশ দুটির নিরাপত্তাবোধকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেনে আক্রমণের নির্দেশ দেওয়ার পর ন্যাটো জোটে যোগদানের বিষয়ে দেশ দুটির জনগণের মনোভাবে নাটকীয় পরিবর্তন আসে।

বেশ কয়েক বছর ধরে ফিনল্যান্ডে ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে সমর্থন ছিল ২০-৩০ শতাংশের মতো। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশ। এই দেশ দুটি ন্যাটোর ঘনিষ্ঠ অংশীদার এবং এতদিন পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল। বিশেষ করে ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতিতে রাশিয়ার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

এখন তারা ন্যাটো মিত্রদের কাছ থেকে নিরাপত্তা সহায়তা পাওয়ার আশা করছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ যদি– যদি মস্কো পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। বুধবার ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এমন পরিস্থিতি তারা সহযোগিতায় পাশে দাঁড়াবে।

ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান করলে তারা ডেনমার্ক, নরওয়ে ও আইসল্যান্ডে সঙ্গে যৌথ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সমন্বয় করতে পারবে। যা নরডিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির আওতায় পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছিল না। ন্যাটোতে যোগদানের অর্থ হলো সেনাদের যৌথ কমান্ডের অধীনে রাখা।

এতে করে বাল্টিক সাগরে নরডিক অঞ্চলে কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী হবে ন্যাটোর। যেখানে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুগ ও কালিনিনগ্রাদ ছিটমহলে প্রবেশের রুশ সমুদ্রসীমা।

সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড যৌথভাবে আর্কটিকের সমুদ্রসীমা অঞ্চল ও উত্তর আটলান্টিকে সৃষ্ট  প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করবে। যেখানে উত্তর কোলা উপত্যকায় রাশিয়া নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে আসছে। একীভূত ন্যাটোর পরিকল্পনা করা সরল এবং অঞ্চলটির সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে সহজে।

দেশ দুটি ন্যাটোর ঘনিষ্ঠ অংশীদার। তারা জোটের কার্যক্রম ও আকাশনীতিতে ভূমিকা রেখে আসছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা ইতোমধ্যে জোটটির সদস্য হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করেছে। উভয় দেশই নিজেদের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন ও নতুন সরঞ্জামে বিনিয়োগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কয়েক ডজন অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনছে ফিনল্যান্ড। সুইডেনেরও রয়েছে সেরা মানের গ্রিপেন যুদ্ধবিমান।

ফিনল্যান্ড বলছে, তারা ইতোমধ্যে জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষায় ব্যয় করতে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা নির্দেশনা মেনে চলছে। সুইডেনও সামরিক বাজেট বাড়াচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৮ সালে তারা লক্ষ্য অর্জন করবে।

পুতিন দাবি করেছেন, ন্যাটোর সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হবে। ৯ মে রাশিয়ার বিজয় দিবসের ভাষণে তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য পশ্চিমাদের দায়ীঢ করেছেন। কিন্তু ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের জনমত ইঙ্গিত দিচ্ছে, তিনি তাদেরকে ন্যাটোর হাতে তুলে দিয়েছেন।

ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়ার সঙ্গে জোটটির সীমান্ত দ্বিগুণ হবে। এতে করে মস্কোকে আরও ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত সুরক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে।

পুতিন অঙ্গীকার করেছেন, দেশ দুটি ন্যাটোতে যোগ দিলে ‘সামরিক, কারিগরি’ পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু ফিনল্যান্ড সীমান্তের কাছে রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার অনেক সেনাকে ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে। পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ইউনিট ইউক্রেনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে।

এখন পর্যন্ত মস্কো উদ্বেগজনক কিছু করেনি। মাঝে মধ্যে তাদের যুদ্ধবিমান দেশ দুটির আকাশসীমা লঙ্ঘন করা ছাড়া। বৃহস্পতিবার ক্রেমলিন জানিয়েছে, তাদের পাল্টা পদক্ষেপ নির্ভর করবে রুশ সীমান্তের কতটা কাছাকাছি ন্যাটোর সামরিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে সেটির ওপর।

ন্যাটো জোটের কয়েকজন কর্মকর্তা আশঙ্কা করছেন রাশিয়া হয়ত পারমাণবিক অস্ত্র বা আরও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কালিনিনগ্রাদ ছিটমহল, বাল্টিক সাগরে মোতায়েন করতে পারে। যা পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার মাঝখানে অবস্থিত।