ইউক্রেন থেকে চুরি করা শস্য কোথায় নিচ্ছে রাশিয়া?

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য চুরির অভিযোগ নতুন নয়। সোমবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, এমন অভিযোগের জোরালো প্রমাণ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রুশ বাহিনী পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে শস্য এবং তাদের উৎপাদিত অন্যান্য সামগ্রী চুরি করছে। এর স্বপক্ষে শক্তিশালী প্রমাণাদি রয়েছে।

বিবিসি কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছে। শস্য কোথায় যাচ্ছে সেটি ট্র্যাক করার জন্য স্যাটেলাইট ইমেজ এবং শিপিং ডেটা বিশ্লেষণ করেছে।

ফ্রন্টলাইন থেকে কয়েক ডজন মাইল দূরে কৃষক দিমিত্রো বর্ণনা করছিলেন, কিভাবে তার ২৫ বছরের ব্যবসা রুশ আগ্রাসনের মাত্র চার মাসের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে।

বিবিসি ২০০ এরও বেশি কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে যাদের জমি এখন রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলে। প্রতিবেদনে দিমিত্রো নামের যে কৃষকের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে সেটি আসলে তার প্রকৃত নাম নয়। রুশ পক্ষের প্রতিশোধ থেকে বাঁচাতে রিপোর্টে তার ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

দিমিত্রো বলেন, ‘তারা আমাদের শস্য চুরি করেছে। আমাদের উপকরণগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, রুশ বাহিনী এখন হাজার হাজার হেক্টর খামারের ৮০ শতাংশেরই দখল নিয়েছে। তারা শস্যাদি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।

একটি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনায় রুশ বাহিনীর প্রবেশের মুহূর্তের সিসিটিভি ফুটেজ হাতে পেয়েছে বিবিসি। তবে খামার মালিকদের পরিচয় গোপন করার জন্য ওই ভিডিওতে আশেপাশের কিছু জায়গা ঝাপসা করে দিয়েছে তারা।

ফুটেজে দেখা যায়, একজন সৈনিক একটি নিরাপত্তা ক্যামেরা দেখে তাতে গুলি করে, কিন্তু সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

খাদ্যশস্যের ট্রাকগুলো চুরি হয়ে যায়। তবে দিমিত্রো বলছিলেন, এসব ট্রাকের কয়েকটিতে জিপিএস ট্র্যাকার লাগানো ছিল। এই ডাটা ব্যবহার করে তারা জানতে পারেন, ট্রাকগুলো ক্রিমিয়াতে গেছে। ২০১৪ সালে এই ক্রিমিয়ার দখল নিয়েছিল রাশিয়া।

জিপিএস ডাটা অনুযায়ী, ক্রিমিয়ার ওকটিয়াবার্স্কে শহরের একটি গুদামের কাছে গিয়ে ট্রাক থেমে যায়। ওই এলাকাটি খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য সুপরিচিত।

এ বছরের ১৪ জুন থেকে স্যাটেলাইট ছবিতে আপনি সেখানকার রাস্তায় ট্রাকের লাইন দেখতে পাবেন।

ক্রিমিয়ার ওকটিয়াবার্স্কে এলাকার স্টোরেজ সাইটটির অবস্থান একটি রেল লাইনের পাশে। রাশিয়া বা দক্ষিণ ক্রিমিয়ার বন্দরে শস্য পরিবহনের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। স্টোরেজ সাইটটির ওপরের অংশেও রুশ আগ্রাসনের চিহ্ন জেড প্রতীক রয়েছে।

দীর্ঘ এলাকাজুড়ে ট্রাকের লাইন 

বিবিসির খবরে বলা হয়, চুরি করা শস্যের পৃথক চালান ট্র্যাক করা খুব কঠিন। কিন্তু প্রচুর প্রমাণ রয়েছে যে, এর বেশিরভাগই ক্রিমিয়াতে যায়। দুইটি প্রধান এন্ট্রি পয়েন্ট- সোনাল এবং আর্মিয়ানস্কের স্যাটেলাইট ইমেজ রয়েছে। সেখানে আপনি বিপুল সংখ্যক যানবাহন জড়ো হতে দেখবেন। শস্য এবং অন্যান্য সামগ্রী পরিবহনে এসব যানবাহন ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। ১৭ জুন চনহার এন্ট্রি পয়েন্ট থেকে তোলা একটি ছবিতে পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকাজুড়ে ট্রাকের লাইন দেখা যায়।

ক্রিমিয়ার সড়কে এই পরিমাণ যানবাহন চলাচলের বিষয়টি অস্বাভাবিক। ২০১৪ সালে রাশিয়া অঞ্চলটি দখল করে নেওয়ার পর থেকে সেখানে ইউক্রেনের আর কোনও প্রবেশাধিকার ছিল না। ফলে এই সময়ে ইউক্রেন থেকে সেখানে আর খাদ্যশস্য যাওয়ার সুযোগ ছিল না।

খালাসের পর খালি ট্রাকগুলো রুশ সেনাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ায় অধিক সংখ্যক যানবাহনের বিষয়টি কিছুটা ব্যাখ্যার অবকাশ থাকতে পারে। তবে এটা স্পষ্ট যে, অনেক ট্রাকই শস্য বহন করছে। এর মধ্যে ইউক্রেনীয় কৃষকদের কাছ থেকে নেওয়া সূর্যমুখী বীজের মতো অন্যান্য সামগ্রীও রয়েছে।

ক্রিমিয়ার ঝাঙ্কোই শহরের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ট্রাকগুলো একটি শস্য সংগ্রহস্থলের পাশে এবং সংযুক্ত ট্রেন স্টেশনের কাছে একটি রাস্তায় অপেক্ষা করছে। ছবিতে স্টোরেজ সাইটের পাশের স্টেশনে শস্য এবং অন্যান্য পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ওয়াগনসহ মালবাহী ট্রেনের উপস্থিতি স্পষ্ট।

ঝাঙ্কোই থেকে ট্রেনগুলি সেভাস্টোপল এবং কের্চ বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত। ইউক্রেনে থেকে চোরাইকৃত খাদ্যশস্য সেখান থেকে অন্যত্র সরানো যেতে পারে।

ক্রিমিয়া থেকে কোথায় যায় ইউক্রেনের শস্য?

কিয়েভের ব্ল্যাক সি স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের একজন বিশেষজ্ঞ আন্দ্রি ক্লিমেনকো। নিয়মিতভাবে তিনি ক্রিমিয়ার চারপাশে জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, ‘তারা প্রথমে দখলকৃত ক্রিমিয়াতে শস্য নিয়ে যায়। সেখান থেকে তারা এগুলো কের্চ বা সেভাস্তোপল বন্দর অভিমুখে পরিবহন করে। তারপর রুশ জাহাজে ইউক্রেনীয় শস্য লোড করা হয়। সগুলো কের্চ প্রণালীতে চলে যায়।’

আন্দ্রি ক্লিমেনকো বলেন, ‘কের্চ প্রণালীতে তারা ইউক্রেনের শস্য ছোট জাহাজ থেকে বাল্ক ক্যারিয়ারে স্থানান্তর করে। সেখানে ইউক্রেনীয় শস্যাদি রুশ খাদ্যশস্যের সঙ্গে মেশানো হয়। অথবা কিছু ক্ষেত্রে তারা কেবল এগুলো রুশ খাদ্যশস্য; এমনটা দেখাতে এই এলাকা হয়ে যাত্রা করে।’

সেক্ষেত্রে ইউক্রেন থেকে চোরাইকৃত খাদ্যশস্যকে রুশ শস্য হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়ে রফতানি করা হয়।

বিবিসি বলছে, জাহাজগুলো প্রায়ই সিরিয়া বা তুরস্কের দিকে চলে যায়। তবে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেছেন, তারা ইউক্রেনীয় শস্য তুরস্কে পাঠানোর বিষয়ে তদন্ত করেছে। তবে এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগের কোনও প্রমাণ মেলেনি। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে, জাহাজগুলো রুশ বন্দর থেকে ছেড়েছে। নথি অনুযায়ী, সেগুলোতে থাকা সামগ্রীর উৎপত্তিস্থলও রাশিয়া।’