বিশ্ব মন্দা কি আসন্ন?

বছরের শুরুতে গুঞ্জনের মতো বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার কথা আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা ও সতর্কতা জোরালো হচ্ছে।

গত সপ্তাহে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-এর প্রধান থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা প্রবণতার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

বুধবার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রকাশিত জরিপের ফলে দেখা গেছে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ২২টি সরকারি ও বেসরকারি খাতের অর্থনীতিবিদদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭জন বলেছেন তারা মনে করেন ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিতে পারে।

গ্লোবাল রিসেশন প্রোবাবিলিটি মডেলের জন্য পরিচিত ফ্লোরিডাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেড ডেভিস রিসার্চ বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা আরও জোরালো করেছে। তারা বলছে, আগামী বছর মন্দা দেখা দেওয়ার সম্ভাব্য হার ৯৮.১ শতাংশ। যা ২০২০ সালে কোভিড মহামারি সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক নিম্নমূখীতা ও ২০০৮-০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকটের তুলনায় বেশি।

ইউক্রেনে যুদ্ধ, চীনের ড্রাকোনিয়ান মহামারি নীতি এবং মূল্যস্ফীতির দ্রুত বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। বিনোয়াগকারীরা নির্দিষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের পথে এগোচ্ছে বাকি বিশ্ব।

ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও অপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদ বৃদ্ধির কর্মকাণ্ড ব্যবস্থাপনা কঠিন। যা ব্যবসায়ী ও পরিবারগুলোর ঋণ ও বিনিয়োগের ব্যয় বৃদ্ধি করে। অতীতের মন্দাগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকে দায়ী করা হয়।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেরেমি সিজেলসহ সমালোচকরা অভিযোগ করছেন, এবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক দেরি করে ফেলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ার জেরোমি পওয়েল গত সপ্তাহে স্বীকার করেছেন, কর্মকর্তারা জানেন না তাদের মূল্যস্ফীতির প্রচেষ্টা মন্দার দিকে নিয়ে যাবে কিনা অথবা মন্দা কতটা ভয়াবহ হবে।

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক পাও-লিন তিয়েন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালের শেষ কয়েক মাসে যদি মূল্যস্ফীতি কমে আসার কোনও ইঙ্গিত না থাকে তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে সুদের হার ২০২২ সালের চেয়ে বেশি হবে। আমার মতে তখন অর্থনীতি মন্দায় পড়বে।

তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয় অপর দেশগুলোর ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যদি নিজেদের মুদ্রা বা মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়াতে থাকে ক্রমাগত তাহলে মন্দা এড়ানো যাবে না।

ডিউক ইউনিভার্সিটির ফুকুয়া স্কুল অব বিজনেস-এর অধ্যাপক ক্যাম্পবেল আর.হাভি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতিকে সহজে মন্দার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর মূল্যস্ফীতি কমাতে মন্দা খুব কার্যকর হবে।

তিনি বলেন, কিন্তু মন্দা খুব বেদনাদায়ক। কেউ ছাঁটাই হতে চায় না বা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সহযোগিতা সংগ্রহে বাধ্য হতে চায় না।

ঝুঁকিতে ইউরোপ ও এশিয়া

যুক্তরাষ্ট্র বাদে বিশ্বের অপর দেশগুলোতেও আশা সঞ্চারের মতো কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। ইউরোপের তিনটি বৃহৎ অর্থনীতি জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্য আগামী বছর দীর্ঘ মন্দায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে সৃষ্ট জ্বালানি সরবরাহে সংকটের কারণে। এমন আশঙ্কার কথা সোমবার জানিয়েছে অর্গানাইজেশন ফর ইকনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)।

২০২৩ সালে ইউরো অঞ্চলে মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করছে ওইসিডি। যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, অঞ্চলটির বেশিরভাগ দেশ আগামী বছর মন্দায় পতিত হবে।

এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে অর্থনৈতিক সংকোচন এড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও চীনের ‘জিরো কোভিড’ লকডাউন ও সীমান্তে বিধিনিষেধের ফলে অঞ্চলটির প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলের অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে তিন দশমিক দুই শতাংশ করেছে। যা এপ্রিলের পূর্বাভাস ৫ শতাংশের চেয়ে কম। চীনের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস অর্ধেক কমিয়ে দুই দশমিক আট শতাংশ করা হয়েছে।

হংকংয়ের ন্যাটিক্সিস-এর সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ত্রিন নগুয়েন বলেছেন, সুদের হার বৃদ্ধির বিপর্যয় থেকে এশীয় অর্থনীতির দেশগুলো রক্ষা পাবে না। যদিও এই অঞ্চলের অর্থনীতিগুলো মন্থর হলেও একেবারে স্থবির হয়ে যাবে না।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে মনে হচ্ছে এশিয়ার প্রবৃদ্ধি কমবে। দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলো বাইরের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে ভুগতে পারে বেশি।  

ডিউক অধ্যাপক হার্ভি বলেন, মূল্যস্ফীতি হলো বৈশ্বিক ঘটনা। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি সাধারণত মন্দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র যদি মন্দায় পড়ে তাহলে তা বিশ্ব মন্দার দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যখন ইউরোপ ইতোমধ্যে মন্দায় পতিত হয়েছে।

সূত্র: আল জাজিরা