রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর

স্মার্টফোন যখন ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধের হাতিয়ার

বর্তমানে মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন। আর এই স্মার্টফোন ব্যবহার করে সহজেই যেকোনও ভিডিও, ছবি সংরক্ষণ বা সরবরাহ করা যায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। রয়েছে ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, ইউটিউব, টেলিগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও। স্মার্টফোনের এত সব সুবিধা ও বিপুল ব্যবহার অন্যান্য যুদ্ধের চেয়ে আলাদা করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে। যুদ্ধে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত নথিভুক্ত যুদ্ধ হলো ইউক্রেনের এই যুদ্ধ। এর আগে এরকম বড় কোনও যুদ্ধে স্মার্টফোনের এত বিস্তৃত ব্যবহার ছিল না, ছিল না প্রযুক্তির এত সহজলভ্যতাও। ফোন ব্যবহার করে যে কেউ যুদ্ধের ছবি বা ভিডিও রেকর্ড করতে পারছে এবং ছড়িয়ে দিতে পারছে বিশ্বব্যাপী। তদন্তকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব ছবি, ভিডিও ও অডিওতে থাকা শব্দগুলো তদন্তের কাজে ব্যবহার ছাড়াও যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ হিসেবেও সংরক্ষণ করে রাখছে।

এ তো গেলো ভিডিও বা ছবি সংরক্ষণ ও সরবরাহের কথা। তবে শুধু এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি যুদ্ধে স্মার্টফোনের অবদান। ইউক্রেনের ভেতরে বা আশপাশের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিয়ে কর্তৃপক্ষের জন্য সেন্সর হিসেবেও কাজ করছে এসব স্মার্টফোন। 

ব্যবহারকারীদের ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, সামরিক লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করতে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পেতে এসব স্মার্টফোন থেকে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ সহজেই সামরিক বাহিনীর কাছে চটজলদি তথ্য পাঠাতে পারছে। ড্রোন বা সামরিক সরঞ্জামের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা ছাড়াও সহজেই তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে।

সুইডিশ প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ম্যাথিউ ফোর্ড এ বিষয়ে বলেন, ‘বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যুদ্ধটি হাতের মুঠোয়। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সরাসরি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে যেকোনও কিছু প্রকাশ করা ছাড়াও শত্রুদের অবস্থান, কার্যকলাপ সম্পর্কেও জানা সম্ভব’।

স্মার্টফোনের সামরিক উপযোগিতাও কম না। ছবি: এপি

ইউক্রেন যুদ্ধে স্মার্টফোনের সামরিক উপযোগিতাও একেবারে কম নয়। ওয়াশিংটনের কৌশলগত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা কেন্দ্রের সামরিক কৌশলবিদ ও ইতিহাসবেত্তা এলিয়ট কোহেন বলেন, ‘গুপ্তচরদের জন্য স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো বিষয় হলো স্মার্টফোন, আর যারা গুপ্তচরদের প্রতিহত করতে চায়, তাদের কাছে স্মার্টফোন যেন একটি দুঃস্বপ্নের নাম। কেননা, সহজেই স্মার্টফোন ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের গতিবিধি পর্যালোচনা করা যায়’।

রুশ যোদ্ধাদের অন্যতম অংশ হলো চেচেন বাহিনী। টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে যুদ্ধের বেশ কিছু ভিডিও পোস্ট করে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে এনেছিল তারা। সেসব ভিডিও থেকে তাদের অবস্থান খুঁজে বের করে আক্রমণ করে ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনী। এই হামলায় একসঙ্গে প্রায় ৩০ জন চেচেন সেনার প্রাণহানির কথা বলেছেন ইউক্রেনের একজন কর্মকর্তা।

স্মার্টফোনের ব্যবহারে রুশ আক্রমণ প্রতিরোধে থাকা ইউক্রেনের জন্য আরও কিছু সুবিধা রয়েছে। তথ্যই এখন যুদ্ধের বিশাল একটি হাতিয়ার। আর স্মার্টফোনের ব্যবহারে তথ্যযুদ্ধে এগিয়ে আছে ইউক্রেন বাহিনী। বিশ্বব্যাপী মানুষের সমর্থন আদায়ে তথ্যের চেয়ে বড় হাতিয়ার আর কিই বা হতে পারে!

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো স্মার্টফোনের এসব সুবিধাকে যেন আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে রাশিয়ায় ফেসবুক ও অন্যান্য কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় টেলিগ্রাম বেশ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। টেলিগ্রামের মাধ্যমেই যুদ্ধে উভয়পক্ষের বেশিরভাগ তথ্য ও নথি আদান-প্রদান হচ্ছে।

গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিভাগের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু হসকিন্স বলেন, ‘কোনও ধরনের পরিবর্তন বা পরিমার্জন ছাড়াই যুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থা বোঝা যায় টেলিগ্রাম থেকে। এত ভয়াবহ অবস্থা আমরা আগে কখনও দেখিনি’।

সুইডিশ প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ম্যাথিউ ফোর্ড এ বিষয়ে বলেন, ‘কিছু চ্যানেলে মৃত মানুষ ও যুদ্ধবন্দিদের ছবি এবং ভিডিও ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। স্পষ্টতই এসব ছবি ও ভিডিওর প্রচার জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন’। 

বার্লিনভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথি সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান ‘নেমোনিক’ ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরের মধ্যেই প্রায় ২৪ লাখ ডিজিটাল রেকর্ড সংগ্রহ করে ফেলেছে। অথচ এরকমই আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘সিরিয়ান আর্কাইভ’, সিরিয়া যুদ্ধের ১১ বছরে মাত্র ৫০ লাখ ডিজিটাল রেকর্ড সংগ্রহ করতে পেরেছিল। বলা বাহুল্য, স্মার্টফোনের বিপুল ব্যবহারের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে।

নেমোনিকের তদন্তকারী ব্রায়ান পার্লম্যান জানান, এসব ফুটেজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ কম্পিউটারের আরও বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্ত করা হবে। প্রতিটি ফাইল আলাদা আলাদা নামে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যাতে কোনোটির সঙ্গে অন্য কোনও ফাইল মিলে না যায় বা কোনও ফাইল হারিয়ে না যায়।

দুটি হাসপাতালসহ কয়েকটি বেসামরিক আবাসিক এলাকায় রুশ হামলার কথা এক তদন্তে নিশ্চিত করেছে ‘নেমোনিক’। যদিও যুদ্ধের শুরু থেকেই বেসামরিক আবাসিক এলাকায় হামলার কথা অস্বীকার করে চলেছে মস্কো।

স্মার্টফোন ফুটেজ ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নথি সংগ্রহকারী আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো বেলিংক্যাট। বেলিংক্যাটের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়ট হিগিন্স জানান, উন্মুক্ত প্রমাণাদি ব্যবহার করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্দেশ্যে নথি সংগ্রহ করছেন তারা। তিনি বলেন, ইতিহাসে এটিই প্রথম কোনও যুদ্ধ, যেখানে সব নথি ও প্রমাণ ফুটেজসহ প্রায় সবকিছুই উন্মুক্ত।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অবলম্বনে।