শি-পুতিনের সখ্যের দুই দিন, কে ছিলেন ‘বস’?

ক্রেমলিনে ১৫ শতকের ঐতিহাসিক ফেসেটস চেম্বারে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাদা ওয়াইনের গ্লাস হাতে তুলে নেন। ‘আমাদের মহান বন্ধু শি এবং রাশিয়া-চীন অংশীদারত্ব গভীর করার’ কামনা করার আগেই অবশ্য ‘গানবেই’ প্রবাদ দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন পুতিন। এই প্রবাদের চীনা অর্থ হলো ‘খালি গ্লাস’।

পুতিনের ভাষণ ছিল ক্রেমলিনে চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার দুই দিনের চূড়ান্ত প্রকাশ। পশ্চিম থেকে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দুই দেশের সম্পর্ক দৃঢ় করার লক্ষ্যে শি জিনপিংয়ের এই মস্কো সফর।

সোমবার (২০ মার্চ) মস্কোর ভানকোভা বিমানবন্দরে পূর্বনির্ধারিত সফরে বোয়িং-৭৪৭ উড়োজাহাজে অবতরণ করেন শি। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফর পুতিনের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ইতোমধ্যে তা স্পষ্ট।

চীনা মালিকানাধীন পাঁচ তারকা সোলাক্স হোটেলে যাওয়ার পথে রাস্তার দুই পাশে রাশিয়ার পক্ষ থেকে টানানো বিলবোর্ডগুলো শোভা পাচ্ছিল। বিশাল বিলবোর্ডগুলো পার হয়ে হোটেলে প্রবেশ করেন শি। মস্কোয় অবস্থিত ১৩ একর জমিতে অবস্থিত সোলাক্সের আশপাশে লাগানো গাছগুলোও চীন থেকে আনা হয়েছে। হোটেলের কক্ষগুলো ‘ফেংশুইনীতির’ ওপর ভিত্তি করে নকশা করা।

হোটেলে প্রবেশের কয়েক ঘণ্টা পর একটি ছোট টেবিলে প্রথমে করমর্দন করেন দুজন। এরপরই শি-কে ‘প্রিয় বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেন পুতিন।

ওই দিন সোমবার সন্ধ্যায় পুতিন ও শি চার ঘণ্টারও বেশি সময় বৈঠক করেন। রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগর উপকূল থেকে কোয়েল ব্লিনিস, সাইবেরিয়ান সালমন, চেরি সসে ভেনিসন ও ওয়াইন সমন্বিত একটি নৈশভোজ উপভোগ করেছেন শি। রাতের খাবার শেষে বিরল ঘটনা লক্ষ করা যায়। একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হাসিমুখে শি-কে তার গাড়ির পর্যন্ত এগিয়ে দেন পুতিন।

শি জিনপিংকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন পুতিন। ছবি: রয়টার্স

পূর্বের ধারণা মতো পশ্চিমা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত বড় টেবিলে বসতে হয়নি শি-কে। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট মস্কোয় ভ্রমণ করলে পুতিনের সঙ্গে ওই বিশাল টেবিলে আলোচনা করতে হয়েছে।

পর দিন মঙ্গলবার (২১ মার্চ) ক্রেমলিনে পুতিন তার বন্ধু শি জিনপিংয়ের জন্য চোখজুড়ানো লালগালিচার আয়োজন করেন। ওই গালিচার মাড়িয়ে ক্রেমলিনের বিশাল হলরুমের প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেন শি। হলরুমের অন্য পাশ দিয়ে ঢোকেন পুতিন।

সাজানো গোছানো আয়োজনটির পরতে পরতে ছিল রাজকীয় আড়ম্বর। শি ও পুতিন একে অপরের দিকে এগিয়ে যান, হলরুমের মধ্যখানে দুজন মিলিত হন। হাসিমুখে করেন করমর্দন।

যখন দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হচ্ছিল, প্রায় একই রকম দেখতে মেরুন রঙের টাই পরা দুই নেতা সটান দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের দুজনের পাশে ছিল রাশিয়া ও চীনের বিশাল দুটি পতাকা। দুজনকে পতাকার উচ্চতার তুলনায় একটু খাটো দেখাচ্ছিল। কক্ষজুড়ে ছিল সোনালি ঝাড়বাতি।

শি জিনপিংয়ের সফরের দ্বিতীয় দিনে চাকচিক্যের বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যেখানে রাশিয়ার বৃহত্তম কোম্পানির প্রধানদের অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

শি জিনপিংয়ের সফরকে উপেক্ষা করতে পারেনি মস্কোবাসীও। পুলিশ শহরের কেন্দ্রস্থলের বেশিরভাগ সড়ক বন্ধ করে দেওয়ায় রাজধানীতে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে চীনা প্রসিডেন্টের আগে ধারণকৃত বিভিন্ন উক্তি দেখতে পেয়েছেন রুশ নাগরিকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই নেতার শরীরের ভাষা ইঙ্গিত দিচ্ছে, শি ছিলেন অনেক বেশি দুর্ভাবনাহীন এবং কর্তৃত্বপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইনফ্লুয়েন্স সলিউশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কারেন লিওং বলছেন, আনুষ্ঠানিক করমর্দনের সময় পুতিনের হাত ছুঁয়ে মুহূর্তেই ছেড়ে দেন প্রেসিডেন্ট শি। এই আচরণ ইঙ্গিত দিচ্ছে, মস্কো সফরে থাকলেও শি দুই দেশের সম্পর্কে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন।

এ নিয়ে রুশ ব্লগার পাভেল প্রিয়ানিকভ বলেন, সাক্ষাতের প্রথম মুহূর্ত থেকেই মনে হচ্ছিল শি জিনপিং নিজেকে ‘বস’ ভাবছেন।

এমন সময় শি মস্কো সফর করেছেন যখন বেইজিংয়ের ওপর রাশিয়ার নির্ভরশীলতা বাড়ছে এবং ক্রেমলিন ঘনিষ্ঠরা যদিও বারবার জোর দিয়ে বলছিলেন, এই বৈঠক দুই সম-অবস্থানের দেশের মধ্যে হচ্ছে।

ক্রেমলিনের সাবেক উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সের্গেই মারকভ বলেছেন, রাশিয়া ও চীন সমান অংশীদার এবং মিত্র। ফলে, রাশিয়াকে চীন অধীনস্থ করে ফেলছে বলে কিছু পড়েন কেউ, তাহলে বুঝতে হবে এটি পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত ধারণা।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান