ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলো কিয়েভকে অতিরিক্ত ২১ বিলিয়ন ইউরো (১৮.২ বিলিয়ন পাউন্ড) সামরিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি আলোচনা পিছিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। ব্রাসেলসে ইউক্রেন ডিফেন্স কন্টাক্ট গ্রুপের বৈঠকে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলি বলেছেন, গত মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পুতিন প্রত্যাখ্যান করেছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এ খবর জানিয়েছে।
হিলি বলেন, পুতিন শান্তি চান বলে দাবি করলেও তিনি পূর্ণ যুদ্ধবিরতি মানেননি। রাশিয়ার বাহিনী ইউক্রেনের সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে গোলাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে।
শুক্রবার ব্রিটেন ও জার্মানির যৌথ আয়োজনে রামস্টাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ৪০টির বেশি দেশ অংশ নেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি উপস্থিত না থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দেন।
জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস ট্রাম্প প্রশাসনের অনুপস্থিতিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তিনি স্বীকার করেছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে শান্তি অর্জন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না এবং ইউক্রেন এখন একটি বৃহত্তর সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
পিস্টোরিয়াস বলেন, এটি স্বাধীনতা ও নিপীড়নের মধ্যে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে, গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদীতার মধ্যে সংঘাত। তিনি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখারও প্রতিশ্রুতি দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি প্রচেষ্টা ব্যর্থ?
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার প্রচেষ্টা এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ শুক্রবার সেন্ট পিটার্সবার্গে পুতিনের বিনিয়োগ উপদেষ্টা কিরিল দিমিত্রিভের সঙ্গে আলোচনা করেন। এর আগে গত সপ্তাহে দিমিত্রিভ ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। উইটকফের পুতিনের সঙ্গেও বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তবে ক্রেমলিন সতর্ক করে দিয়েছে যে কোনও বড় অগ্রগতি বা যুগান্তকারী সমাধান আশা করা উচিত নয়।
হোয়াইট হাউজের সঙ্গে আলোচনায় রাশিয়া কোনও ছাড় দিতে অস্বীকার করেছে। মস্কোর দাবি অনুযায়ী, ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ, ভলোদিমির জেলেনস্কির পশ্চিমাপন্থি সরকারের অপসারণ, ন্যাটোতে ইউক্রেনের সদস্যপদ নিষিদ্ধ এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।
বৈঠকের আগে ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে পুতিনকে বিরল হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখেছেন, রাশিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে। এই ভয়াবহ ও অর্থহীন যুদ্ধে প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে—এমন এক যুদ্ধ যা কখনোই হওয়ার কথা ছিল না এবং আমি যদি প্রেসিডেন্ট হতাম তবে এটি হতো না!!!
ট্রাম্প এর আগে পুতিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হওয়ার সমালোচনা করলেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ওপর চাপ বাড়ানোর কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। তার বিশেষ দূত উইটকফ রাশিয়ার প্রচারণার পক্ষে কথা বলে গেছেন, এমনকি তিনি দাবি করেছেন যে রাশিয়া-দখলকৃত ইউক্রেনের অঞ্চলগুলো মস্কোর সঙ্গে একীভূত হওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে।
রাশিয়ার সামরিক অভিযান তীব্র হচ্ছে
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পর থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনে বিমান হামলা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। এই সপ্তাহে সুমি ও খারকিভ অঞ্চলে রাশিয়া বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি সীমান্তবর্তী গ্রাম দখল করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ৯ মে (রাশিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয় দিবস)-এর আগে যতটা সম্ভব ইউক্রেনের ভূমি দখল করতে চাইছে মস্কো। এস্তোনিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হ্যানো পেভকুর বলেন, এ কারণেই আমাদের যত দ্রুত সম্ভব ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা পাঠানো বাড়াতে হবে।
ব্রাসেলসের বৈঠকে ভিডিও কনফারেন্সে ভাষণ দিতে গিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মিত্র দেশগুলোর কাছে নতুন প্যাট্রিয়ট মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহের আহ্বান জানান। তার এই আবেদনের আগে এই সপ্তাহে রাশিয়ার একটি ব্যালিস্টিক মিসাইল ক্রিভিহ রিহ শহরে একটি খেলার মাঠে আঘাত হানে, যেখানে ৯ শিশু ও ১১ জন নিহত হন। এই শহরেই জেলেনস্কির শৈশব কেটেছে।
জেলেনস্কি বলেন, আমাদের অগ্রাধিকার হলো আকাশ প্রতিরক্ষা। আমাদের মিত্রদের গুদামে পড়ে থাকা প্যাট্রিয়ট সিস্টেমগুলো জীবন রক্ষায় কাজে লাগানো উচিত। তিনি আরও ১০টি প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন।
রামস্টাইন বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিস্টোরিয়াস বলেন, তার দেশ ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে চারটি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম দিয়েছে এবং আরও পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা বিশ্বজুড়ে খোঁজাখুঁজি করছি। যা পাবো, তাই কিনে দেবো।
জার্মানি ইউক্রেনকে আরও চারটি আইরিস-টি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ১৫টি লেপার্ড-১ ট্যাংক, আরও ড্রোন ও এক লাখ আর্টিলারি শেল দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে।
ব্রিটেন ও নরওয়ে ৫৬০ মিলিয়ন ডলারের একটি সামরিক সহায়তা প্যাকেজের অংশ হিসেবে রাডার সিস্টেম, ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ও কয়েক লাখ ড্রোন সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিলি। এ ছাড়া এই বছরই ডাউনিং স্ট্রিট ৪.৫ বিলিয়ন পাউন্ড সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত সামরিক যানবাহন মেরামতের খরচও অন্তর্ভুক্ত।
সেনা পাঠাতে অনিচ্ছুক অনেক দেশ
শুক্রবারের বৈঠকে কতটি দেশ ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে রাজি হয়েছে, তা স্পষ্ট হয়নি। তবে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও বাল্টিক দেশগুলো শান্তিচুক্তি হলে ইউক্রেনে সেনা মোতায়েনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয়টি দেশ এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিলি একটি ‘রিহ্যাশিউরেন্স ফোর্স’ পরিকল্পনাকে ‘প্রায় প্রস্তুত’ বলে অভিহিত করেছেন। এই পরিকল্পনায় বিদেশি সেনাদের ইউক্রেনের ১ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ রণক্ষেত্রের বদলে পিছনে মোতায়েন করে ইউক্রেনের স্থলবাহিনীকে শক্তিশালী করার কথা ভাবা হচ্ছে।
তবে রাশিয়া এই প্রস্তাব পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে। সুইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাল জনসন বলেছেন, সেনা পাঠানোর আগে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দরকার। এই মিশনের লক্ষ্য কী—শান্তিরক্ষা, নিবৃত্তি নাকি আশ্বস্তকরণ?
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ‘ব্যাকস্টপ’ (বিশেষ করে বিমান প্রতিরক্ষা ছাড়া) ছাড়া এই মিশন সফল হবে না বলে ব্রিটেন মনে করলেও ট্রাম্প প্রশাসন তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা ইঙ্গিত দিয়েছে যে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার দায় এখন ইউরোপের।
২০২২ সালে রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণের পর বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেন ডিফেন্স কন্টাক্ট গ্রুপ গঠন করে এর নেতৃত্ব দিতো। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র এই নেতৃত্ব ব্রিটেন ও জার্মানির হাতে ছেড়ে দেয়। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ বলেছেন, আমাদের অগ্রাধিকার এখন এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সীমান্ত।
এই অবস্থানে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে কিছুটা হতাশা দেখা দিয়েছে, তবে তারা ইউক্রেনকে সহায়তা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।