স্বল্পমূল্যের লিডল জিন্সের নেপথ্যচিত্র

ইউরোপের বিখ্যাত জিন্স বিক্রেতা লিডল ঘোষণা দিয়েছে, মাত্র ৫.৯৯ পাউন্ডে (৬৭৫ টাকা) ডেনিম জিন্স বিক্রি করবে। কিন্তু এতো স্বল্পমূল্যে জিন্স বিক্রি করাতে কারা লাভবান হচ্ছেন এবং এ মুনাফার বলি হচ্ছেন কারা?
পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘জিন্স জিনি লিডলের ডেনিম জিন্সের দাম ৫.৯৯ পাউন্ড।’ জার্মান প্রতিষ্ঠান লিডল জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য ফ্যাশন-সচেতন ক্রেতাদের কাছে মাত্র ১২ পাউন্ডে এক জোড়া জিন্স বিক্রি করা। যা অন্যান্য জিন্স বিক্রেতাদের চাপে ফেলবে।

লিডলের সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপন
কিন্তু প্রশ্ন হলো, লিডল কীভাবে এতো স্বল্পমূল্যে জিন্স সরবরাহ করে? এর উত্তর পাওয়া যাবে তাদের জিন্স ক্রয় এবং যে প্রক্রিয়ায় ক্রয় তা খতিয়ে দেখলে। এখানে কোনও ম্যাজিক নেই। যেমনটা তাদের বিজ্ঞাপনে দাবি করা হচ্ছে। হ্যারি পোটার যাদুর কাঠি দিয়ে এসে এসব জিন্স তৈরি করছে না। বস্তুত কোনও একটি ফ্যাক্টরিতে বসে বাংলাদেশি কোনও নারীই এই প্যান্ট তৈরি করছেন। আর  স্বল্প মূল্যে জিন্স বিক্রির নেপথ্যে রয়েছে সস্তা শ্রমের এক নির্মম কাহিনী।
যখন প্রাইমার্কের মতো কোম্পানি জিন্সের দাম ৮ পাউন্ডের নিচে আনতে পারে না, তখন লিডল জিন্সের দাম রাখছে ৫.৯৯ পাউন্ড। কারণ লিডলের জিন্স তৈরির জন্য বাংলাদেশের ওই নারী শ্রমিককে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ২ পেন্স (প্রায় ২২ টাকা)। অথচ গত বছর অক্টোবরে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে কর্মরত কর্মীদের সর্বনিম্ন মজুরি ঘণ্টায় ৮ পাউন্ড ২০ পেন্সে উন্নীত করার ঘোষণা দেয় লিডল। আবার লন্ডনের স্টাফদের লিভিং ওয়েজও দিচ্ছে তারা!

সম্প্রতি তারা ‘লিডল সারপ্রাইজ (লিডল বিস্ময়)’ স্লোগানটি ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। কিন্তু এটা বিস্ময়ের কোনও বিষয় নয়, কারণ আরও কয়েকটি ব্রিটিশ ও মার্কিন কোম্পানির মতো তারাও বেশিরভাগ কাজের অর্ডার বাংলাদেশেই পাঠায়। যেখানে একজন গার্মেন্ট শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ঘণ্টায় ২৩ পেন্সের বেশি নয়।

৫.৯৯ পাউন্ডে ডেনিম জিন্স বিক্রি করার ঘোষণা দিয়ে ইউরোপের বিক্রেতাদের চাপে ফেলেছে লিডল

বৃহস্পতিবার লিডলের ‘নতুন’ ডেনিম জিন্স মার্কেটে এসেছে। যুক্তরাজ্যের ৬০০টি দোকানে যা একযোগে পাওয়া যাচ্ছে। আর নতুন ওই জিন্সের প্রচারণায় লেখা হয়, ‘উই লাভ ডেনিম (আমরা ডেনিম ভালোবাসি)’। আর জিন্সের লেবেলে লেখা আছে, ‘জিন্সটি বাংলাদেশে উৎপাদিত’। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সফরকালে লিডলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা মার্কুস রেনকিন সাংবাদিকদের জানান,  বাংলাদেশ থেকে তারা প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের পোশাক ক্রয় করেন।

৫.৯৯ পাউন্ডে লিডল যে জিন্স গ্রাহকদের দিচ্ছে, বস্তুত তা হলো ‘জেগিংস’ (মেয়েদের পরিধেয় এক ধরনের আঁটোসাঁটো লেগিংস, যা জিন্স কাপড় দিয়ে তৈরি)। লিডলের মতে, এতে দেওয়া হয়েছে ‘আকর্ষণীয় ডেনিম ইফেক্ট’। ৭৭ শতাংশ কটন ফ্যাব্রিকের ওই জেগিংস-এ রয়েছে ওয়েস্ট ব্যান্ড ইলাস্টিক, একটি বোতাম, একটি জিপার, দুটি ব্যাক পকেট এবং দুটি ফ্রন্ট পকেট।

২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গে বাংলাদেশি জিন্স ফ্যাক্টরির উৎপাদন খরচের তালিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, একটি জিপারের দাম পড়ে ১০ পেন্স, একটি বোতাম ৪ পেন্স, প্রতিটা রিভেট ১ পেন্স, এমব্রয়ডারির জন্য ৯ পেন্স, পকেটের জন্য ৬ পেন্স এবং লেবেলের জন্য খরচ হয় ৭ পেন্স। সেলাইয়ের জন্য লাগে আরও ১৯ পেন্স। ওয়াশ, ম্যাটেরিয়েলস এবং আনুষঙ্গিক খরচ মিলে একটা জিন্স প্যান্টের পেছনে মোট খরচ হয় ৩.৯০ পাউন্ডের মতো।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের বেশিরভাগ শ্রমিকের আইনত ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা (প্রায় ৪৮ পাউন্ড)। আর এ ক্ষেত্রে সপ্তাহে ছয় দিন ৮ ঘণ্টা করে হিসেব করলে তাদের মজুরি দাঁড়ায় ঘণ্টায় ২৩ পেন্সের মতো। অথচ ২০১৩ সালে এশিয়ান ফ্লোর ওয়েজ অ্যালায়েন্স-এর প্রকাশিত তথ্যমতে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত ২৩০ পাউন্ড।

বাংলাদেশের একটি গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা

উৎপাদন খরচ বের করার জন্য প্রথমেই জানা দরকার, প্রতিদিন কতো জোড়া জিন্স প্যান্ট সেখানে প্রস্তুত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ফ্যাক্টরিতে একজন শ্রমিক প্রতিদিন ২০ থেকে ৩৩ জোড়া পর্যন্ত জিন্স প্যান্ট প্রস্তুত করেন। আবার ২০১০ সালে গ্লোবাল লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস-এর দেওয়া তথ্যমতে, ২৫ জন শ্রমিকের একটি দল প্রতি ঘণ্টায় ২৫০টি জিন্স প্রস্তুত করতে পারেন। সেই হিসেবে একজন শ্রমিক প্রতি ঘণ্টায় ১০টি এবং প্রতিদিন ৮০টি জিন্স প্রস্তুত করে থাকেন। এ হিসেবে একজন শ্রমিক একটি জিন্স প্যান্ট তৈরিতে ২ থেকে ৯ পেন্স পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন। ব্লুমবার্গের হিসেব মতে, বাংলাদেশে একটি ফ্যাক্টরিতে জিন্স তৈরি করতে খরচ পড়ে ৫৬ পেন্স। আর এ থেকে ওই ফ্যাক্টরি মুনাফা করে ১৬ পেন্স।

এই পর্যন্ত আনুষাঙ্গিক খরচসহ একটি জিন্সের পেছনে ব্যয় হয়েছে সাড়ে চার পাউন্ড। কিন্তু এখনও জিন্স প্যান্টের শিপমেন্ট বাকি আছে। এছাড়া রয়েছে ওয়্যারহাউজ চার্জ ও বন্দর ফি। তাই এখানে আরও ৩০ পেন্স যোগ হবে। তাহলে ব্যয় দাঁড়াবে ৪ পাউন্ড ৮০ পেন্স। এরপর বন্দর থেকে প্যান্টগুলোকে দোকানে নিয়ে যেতে হয়। এতে ব্যয় পড়ে আরও ৫০ পেন্স। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৫ পাউন্ড ৩০ পেন্স। তবে এখানে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

জেগিংসের জন্য মোট বাজেট ৬ পাউন্ড ৩৬ পেন্স। কিন্তু তা ওই প্যান্টের বিক্রয় মূল্যকে অতিক্রম করে। আর এজন্য এগুলোতে খুব কম ও নিম্নমানের ম্যাটেরিয়েলস ব্যবহার করা হয়। বোতাম ও রিভেটেও কয়েক পেন্স কম খরচ হয়। আর এতেই মুনাফার পরিমাণ বেড়ে যায়। আর এই মুনাফা মূলত নির্ভর করে শ্রম মূল্যের ওপর। আর তাই এটা ৫ পাউন্ড ৯৯ পেন্সে বিক্রি সম্ভব।noname
তবে এখানেই শেষ নয়। লিডল’র ক্রয় ক্ষমতা এখনও বাকি আছে। ইউরোপে জেগিংস ও জিন্স মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে আমদানি করা হয়। জার্মানির ওডব্লিউআইএম ও হংকংয়ের টপ গ্রেড ইন্টারন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩০ মিলিয়ন পিস জিন্স ক্রয় করে। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের নিজেদের মুনাফাও রাখতে হয়। এটা প্রশ্নাতীত যে, লিডল নিজেও মুনাফা করে। এই বাস্তবতায় জিন্সের মূল্য দাঁড়ায় ৫ পাউন্ড ৯৯ পেন্স। কারণ লিডল সরাসরি প্যান্ট তৈরি করে নেয় বাংলাদেশ থেকে।
ক্রেতারা কম দামে পোশাক চায় আর লিডলের সাফল্য স্বল্প মজুরিতে জিন্স তৈরিতে। এর ফলেই তারা ২০১৪ সালে ৪ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের জিন্স বিক্রি করতে পেরেছে। এজন্য তাদের প্রয়োজন হয় বাংলাদেশের পোশাক নির্মাতাদের (সাপ্লাইয়ারদের) চাপে রাখা এবং তারা তা করেও। লিডল দাবি করে, তারা গার্মেন্ট শ্রমিকদের পরিস্থিতি ও কাজের পরিবেশ উন্নত করার বিষয়ে সচেতন। কারখানা নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে বলেও দাবি প্রতিষ্ঠানটির। বাস্তবতা হলো এটা সব বিদেশি ক্রেতারাই করে। কিন্তু লিডলসহ কেউই ফলাফল প্রকাশ করে না।

কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। কিছু স্টাফের জন্য লিডল পরীক্ষামূলক বোনাসের ব্যবস্থা করেছিল। তবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কথা মাথায় রেখেই এটা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের ওই ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি এক পয়সাও।

সম্ভাব্য কম মূল্যে যখন কোনও প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করে, তখন কাউকে না কাউকে এজন্য ঠকতে হয়। আর এক্ষেত্রে ঠকছে তারাই যারা জিন্সগুলো তৈরি করছে। বাংলাদেশের কারখানাগুলো খুব ভালো বলে লিডল ঢাকা থেকে জিন্স ক্রয় করছে না, বরং কারখানাগুলোতে খুব স্বল্প মজুরিতে শ্রমিকদের কাজ করানো হয় বলেই তারা এখান থেকে জিন্স ক্রয় করে। তাই মাত্র ৫.৯৯ পাউন্ডে জিন্স বিক্রি করতে পারার নেপথ্যে রয়েছে কম মজুরিতে কাজ করা বাংলাদেশি গার্মেন্ট শ্রমিকরা। আর এটাতে কোনও ম্যাজিক নেই, এটা শ্রম শোষণ। দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে।

/এসএ/এএ/