বিকল্প বাম না বাম বিকল্প, পশ্চিমবঙ্গে বির্তক তুঙ্গে

পশ্চিমবঙ্গের একুশের বিধানসভা ভোটে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ভোটে বামফ্রন্টের ভোটের হার বাড়ায় উল্লসিত সিপিএম। আলিমুদ্দিনের দাবি, রাজ্যের তৃণমূলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গেলে গড়ে তুলতে হবে বাম বিকল্প। যার মানে করলে দাঁড়ায়, নীতিগত ও আর্দশিক অবস্থানকে ঠিক রেখেই বামেরা বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এমনটাই মনে করছে সিপিএম।

সিপিএমের এই অবস্থানের সমলোচনা করেছেন দলটির সাবেক নেতা এবং পরবর্তীতে পিডিএস দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সমীর পুততুন্ড। তার মতে, বাম বিকল্প নয়, চাই বিকল্প বাম। তিনি বলেন, ‘পুরনো কট্টর কমিউনিস্ট ধ্যান ধারণা দিয়ে আর বামপন্থীদের পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের রাজনীতিতে ফেরা সম্ভব নয়।’

এমতাবস্থায় তৃণমূল-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখন কোন পথে যেতে হবে তা নিয়ে বির্তক তুঙ্গে রাজ্যের বাম মহলে। সিপিএমের সাবেক রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রর মতে, ‘বাম বিকল্প প্রতিষ্ঠা মানে শুধু বাম বিকল্পের স্লোগান নয়। বিকল্পের জন্য লড়াই। সরকার করছে না, এটা যেমন ঠিক, তেমনই সরকারের কাজের ওপর আমাদের নির্ভর করলে হবে না। স্থানীয়ভাবে নানা কাজের মাধ্যমে আমাদের বাম বিকল্প প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। শক্তি বাড়াতে হবে। বাম ঐক্যকে সংহত করার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু রাজ্যের পরিস্থিতির বিচারে সব বামপন্থী দলের বোঝাপড়া এক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে তৃণমূল, বিজেপি বিরোধী শক্তিকে এক জায়গায় আনাই আজকের দায়িত্ব। এটিই আমাদের অবস্থান। আমাকে ডাকতে হবে অনেককে। যদি তারা সাড়া না দেন, তবে একলা চলতে হতে পারে। যারা আমার হাত ধরতে চান কিংবা ধরে আছেন, তাদের কী বলব? ধরবেন না।’

সিপিএমের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত বলেছেন, ‘হিন্দুত্বের শক্তি পশ্চিম ভারত ও মধ্য ভারতে শক্তি ভিত্তি তৈরি করে নিয়েছে। এখন এরা পূর্ব ভারতের দিকে ঘাঁটি তৈরি করতে চাইছে। ইতোমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে অনেকখানি পা রাখার জমি পেয়েছে। এই ভয়ঙ্কর শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য সিপিএম এককভাবে যথেষ্ট নয়। অন্যান্য শক্তিগুলোকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ভয়ঙ্কর শক্তিকে মোকাবিলা করতে হবে। রাজ্যে পার্টিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে জনভিত্তি পুনরুদ্ধারের কাজ করতেই হবে। সিপিএমের স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটাতেই হবে। এই কাজ করতে পারলে বামফ্রন্ট এবং বৃহত্তর বাম শক্তির অগ্রগতি ঘটবে। বামফ্রন্ট, বৃহত্তর বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে তৃণমূলের স্বৈরাচারী আক্রমণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি-আরএসএস-র বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে।’

বাম বিকল্প নয়, প্রয়োজন বিকল্প বাম চিন্তার; সেটা বড় দল হিসাবে সিপিএমকে ভাবতে হবে। এমনটাই বললেন সমীর পুততুন্ড। তিনি বলেন, ‘বাম বিকল্প’ ভাবনার পথে হেঁটে জনস্বার্থমুখী বহু আন্দোলনের পথে সমাজের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল বামপন্থীরা। কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে বেশ কিছু বছর। এখনও কেরালায় সরকার চালাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করে বামপন্থী এবং স্থানীয় দলগুলোর সমন্বয়ে অবিজেপি সরকার গঠনে সমর্থন দিয়েছিল কংগ্রেস। কংগ্রেসের সমর্থনে অবিজেপি সরকারে অংশগ্রহণে সিপিআই সম্মত হলেও সিপিএম রাজি না হওয়ায় সেদিন জননেতা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কেন্দ্রে বাম গণতান্ত্রিক  ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এই সিদ্ধান্তকে জ্যোতি বসু প্রকাশ্যে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলেছিলেন। আসলে, সোভিয়েতসহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর বিশ্বের সর্বত্রই সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলো সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলেছে। ভারতের প্রধান বামপন্থী দল সিপিএমের তিনটি রাজ্য সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকলেও এখনও সশস্ত্র সংগ্রামের পুরানো ধারনা থেকে তারা সরে আসতে পারেনি।

কেন বিকল্প বাম? এপ্রশ্নের উত্তরে সমীর বলেন, ‘আজও বামফ্রন্ট থাকলেও কার্যকরী ভূমিকা পালনের প্রশ্নে তাদের সেই ধারও নেই, ভারও নেই। তাই বাম ও সহযোগী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি আবার শুরু হয়েছে। 'বিকল্প বাম' ভাবনার ভিত্তিতে এই আন্দোলনকে পরিচালনা করতে পারলে, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করতে, বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। যারা নিজেদের বিজেপি বিরোধী বলে দাবি করে, সেই সমস্ত শক্তির ঐক্য। এই ঐক্যে আপত্তি করার কি থাকতে পারে? এখানে কোনও নির্দিষ্ট দলের কথা বলা নেই। তাহলে এই কথা বললেই তৃণমূলের কথা আসছে কেন? কারণ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া চলছে, সেখানে তৃণমূলের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রায়শই কংগ্রেস, সিপিএম এবং তৃণমূলকে এক যায়গায় আসতে দেখা যায়। এ রাজ্যে বিজেপিকে পরাস্ত করে তৃতীয় বারের জন্য সরকার গড়েছে তৃণমূল। তৃণমূল সম্পর্কে কংগ্রস এবং সিপিএমের মনোভাব এক নয়। এ রাজ্যের বিগত বিধানসভা নির্বাচনে আইএসএফ-কে কেন্দ্র করে এই মতপার্থক্য প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে কংগ্রেসের মতো বিশ্বাসযোগ্যতা তৃণমূলের নেই। অন্যদিকে কংগ্রেসের চাইতে বেশী বিশ্বাসযোগ্য হবার কথা সিপিএমের। কিন্তু ধাপে ধাপে সেই বিশ্বাসযোগ্যতা তলানীতে এসে ঠেকেছে। অতীতের অনেক কিছু বাদ দিলেও বিগত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের ভুল রণকৌশল শুধু বামফ্রন্টের নয়, সামগ্রিকভাবে বাম আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের শাসনের ফলে জনসমক্ষে একদিকে যেমন সিপিএম এবং বামফ্রন্ট সমার্থক হয়ে গেছে, তেমনি অন্যদিকে বামপন্থা এবং বামফ্রন্ট সমার্থক হয়ে গেছে।

বামফ্রন্টের বাইরের বাম দলগুলোর প্রত্যেকেই সিপিআইএমের চাইতে অনেক ছোট হলেও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সিপিএমের চাইতে বেশী। তাই নতুন 'বিকল্প বাম' ভাবনার দ্বারা বামপন্থী শক্তিগুলো পরিচালিত হলে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সাফল্য অর্জন এমন কিছু কঠিন কাজ নয়।’