মৃন্ময়ী দেবী চিন্ময়ী রূপ পায় মুসলিম মৃৎশিল্পীর হাতে

তার মোবাইলের রিংটোনে বাজে ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল, সকলই ফুরায়ে যায় মা’। সামজিক বয়কটের কারণে মা নূরজাহান বিবিকে কবর দিতে পারেননি কবরস্থানে। তাকে দাফন করতে হয় বাড়ির পাশে। কারণ তিনি পেশা হিসেবে হিন্দু দেব-দেবীর প্রতিমা বানান! কিন্তু সব বাধাকে তুচ্ছ করে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়ার মুসলিম মৃৎশিল্পী নূর মুহম্মদ চৌধুরী আজও প্রতিমা বানিয়ে চলেছেন।

শৈশবে কাদা মাটি নিয়ে খেলতে খেলতেই বানাতেন প্রতিমা। স্কুল যাওয়া আসার পথে স্থানীয় পুকুরে ভাসান দেওয়া প্রতিমার কাঠামো দেখতে পেলেই তা তুলে বাড়িতে এনে কাদামাটির প্রলেপ দিতেন। সেই খেয়ালই আজ যে তার জীবিকা হবে এমনটা ভাবতে পারেননি নূর।

পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া পৌরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের আন্দুলিয়ার অঞ্চলের বছর আটান্নর নূরের এই ভালবাসায় কখনও বাধা দেননি বাবা শেখ জাভেদ। কিন্তু বাধা এসছিল স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে। ফতোয়া জারি করে বলা হয়েছিল, প্রতিমা বানানো যাবে না। মায়ের কবর যেমন দিতে পারেননি, তেমনই বিয়েতেও এসছিল বাধা। কিন্তু হার মানেননি তিনি। ২৩ বছর বয়েসে বিয়ে করেন নূর। পাশে পেয়েছিলেন শ্বশুরবাড়িকে। সাহস যুগিয়ে ছিলেন স্ত্রী রীনা চৌধুরীও। এখন তিনি পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সুপরিচিত মৃৎশিল্পী। হলদিয়ার বড় বড় মণ্ডপে শোভা পায় তার দুর্গা প্রতিমা।

নূর বলেন,  ‘বাধা যে একেবারে আসেনি তা নয়। আমাদের ধর্মের মাওলানারা একটু আধটু বাধা দিয়েছিলেন। আমি তাদের বোঝালাম, এটা আমার পেশা। নজরুল ইসলাম যদি মুসলিম হয়ে শ্যামাসঙ্গীত গাইতে পারেন, ভক্তিমুলক কৃষ্ণের গান গাইতে পারেন, তাহলে আমি কেন মূর্তি বানাতে পারব না। অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। না বুঝলে সেটা তাদের ব্যাপার। তবে বাড়িতে কোনও সমস্যা নেই। বাবা-মা খুব সমর্থন করেছেন। এখন তো বাড়ির সবাই আমরা সঙ্গে কাজ করেন।’

নূর আরও বলেন, ‘প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। তখন বিভিন্ন প্যান্ডেলে পুজো হতো। প্রতিমা দেখতে যেতাম। সেই দেখতে দেখতে মনের ইচ্ছা জাগলো যে প্রতিমা বানাবো। পুরনো কাঠামো তুলে এনে খেলার ছলে প্রতিমা বানিয়ে ফেললাম। তারপর শিল্পী রাধাকৃষ্ণ সামন্তের সঙ্গে যোগোযোগ হয়। ওনার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিমা গড়া শুরু করি। এখন বিভিন্ন ক্লাব, বিভিন্ন গ্রামের পুজোর প্রতিমা তৈরি করছি। সারা বছর ধরে মূর্তি গড়লেও পুজোর সময়েই আমার ব্যস্ততা বেশি। আমার তৈরি মূর্তি যায় জেলার বিভিন্ন মণ্ডপে। সুতাহাটার চৈতন্যপুরের একটি পুজো কমিটির প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেছিলাম ৩৫০ রুপির বিনিময়ে।  আজ তাদেরই প্রতিমার বাজেট ৩৫ হাজার রুপি।’

নূরের ছেলে রাজুও বাবার থেকে শিখেছেন প্রতিমা গড়ার। তার স্ত্রী রীনা বলেন, ‘বাড়ির কাজ আছে, রান্না আছে, তার বাইরে সময় পেলে কাজ করি। আমি সাপোর্ট না করলে কে করবে? আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। এই কাজ করে সংসার চালাই আমাদের ভালো লাগবে না? আমার বাবা জেনেই ওই পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন। প্রতিমা বানান বলে অনেকে বাবাকে মেয়ে দিতে বারণ করেছিলেন। কথা না শোনায় বাবাকে একঘরেও করেছিল।’

প্রতিমা বানান বলে নিজের ধর্মাচারণকে ভুলে যাননি নূর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন নিয়মিত। প্রতিমা বানানো থেকে অবসর পেলে যান মসজিদে। নিজের অজান্তেই সম্প্রীতির এক বিরল নজির তৈরি করে ফেলেছেন নূর।