শিনজো আবের রাজনৈতিক জীবন: উত্থান, বিতর্ক ও মৃত্যু

জাপানে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে পরিচিত ছিলেন তার আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক কৌশলের কারণে। তার অর্থনৈতিক নীতিকে অনেকেই ‘আবেনোমিকস’ নামে ডেকে থাকেন। রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ৬৭ বছরের এই নেতা দুই বার জাপানের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম কার্যকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। ২০০৬ সালে শুরু হয়ে এক বছরের কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় থাকলেও এই সময়ে কিছু বিতর্কও তৈরি হয়।

আরও পড়ুন: বাঁচানো গেলো না শিনজো আবেকে

তবে ২০১২ সালে শিনজো আবে বিস্ময়করভাবে ফিরে আসেন এবং দীর্ঘদিন পর ২০২০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি যখন দায়িত্ব শুরু করেন জাপানে তখন অর্থনৈতিক মন্দা। কাঠামোগত সংস্থার, মুদ্রা ব্যবস্থা সহজ করা, আর্থিক প্রনোদনা দিয়ে যে অর্থনৈতিক নীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাতে মন্দা কাটিয়ে ফের সচল হয়ে ওঠে জাপানের অর্থনীতি।

২০১১ সালে তহুকুতে ব্যাপক ভূমিকম্প ও সুনামির পর জাপানের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করেন আবে। ওই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ২০ হাজার মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ফাটল দেখা দেয়।

ভূমিকম্প ও নিহতদের স্মরণের এক অনুষ্ঠানে আবে

২০২০ সালে কয়েক সপ্তাহ ধরে নানা জল্পনার পর পদত্যাগ করেন আবে। ওই সময়ে অন্ত্রের রোগে ভুগছিলেন তিনি। একই রোগের কারণে তাকে ২০০৭ সালেও সরে যেতে হয়। ২০২০ সালে আবে পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন দলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইয়োশিদি সুগা। পরে ক্ষমতায় আসেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও জাপানের রাজনীতিতে ক্ষমতাধর মানুষ ছিলেন আবে।

ক্ষমতায় উত্থান

শিনজো আবে ছিলেন জাপানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিনতারো আবের ছেলে। এছাড়া তার দাদা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নবুসুকু কিশি। ফলে রাজনৈতিক পরিবারেই জন্ম হয়েছে আবের।

তিনি প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৯৩ সালে। ২০০৫ সালে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হন। ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি তাকে চিফ কেবিনেট সেক্রেটারি নিয়োগ করেন। ২০০৬ সালে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান।

তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন আবে

তবে ওই সময়ে বেশ কিছু বিতর্ক তৈরি হয়। সরকার পেনশন রেকর্ড হারিয়ে ফেললে প্রায় পাঁচ কোটি জাপানি ক্ষতিগ্রস্ত হন। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষের নির্বাচনে এলডিপি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর ওই বছরের সেপ্টেম্বরে অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করেন তিনি।

পরে ২০১২ সালে আবারও প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরে আসেন শিনজো আবে। ওই সময়ে তিনি জানান, চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে গেছেন। ২০১৪ ও ২০১৭ সালের নির্বাচনে জিতে জাপানের সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।

তার জনপ্রিয়তা ওঠানামা করেছে কিন্তু মূলত তিনি চ্যালেঞ্জহীন থেকে গেছেন। এর কারণ এলডিপির মধ্যে তার প্রভাব। তৃতীয় মেয়াদে তাকে নেতা বানাতে দলের নিয়মও বদলানো হয়।

একজন বিতর্কিত জাতীয়তাবাদী

প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতিতে আগ্রাসী অবস্থানের জন্য পরিচিত ছিলেন আবে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সংবিধানও বদলানোর চেষ্টা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া করা ওই সংবিধানকে রক্ষণশীলরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি বাহিনীর লজ্জাজনক পরাজয়ের স্মারক হিসেবে দেখে থাকে।

তার জাতীয়তাবাদী মতামতে প্রায়ই চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা বেড়েছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালে টোকিওর ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের পর এই উত্তেজনা বাড়ে। বিতর্কিত এই স্মৃতিসৌধটির সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে জাপানের সামরিকায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে হিরোশিমা পিস মেমোরিয়ালে ২০১৬ সালে আবে

বারবার ওই স্মৃতিসৌধে তার ভ্রমণে জাপানের বামপন্থীরাও ক্ষুব্ধ হয়। তারা মনে করেন, এর মাধ্যমে আবে যুদ্ধের সময়ে জাপানের সহিংসতার ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

২০১৫ সালে তিনি সমন্বিত প্রতিরক্ষার অধিকারের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এতে জাপান কিংবা মিত্ররা আক্রান্ত হলে বিদেশে সেনা পাঠানোর অধিকার দেওয়া হয়। প্রতিবেশী দেশের পাশাপাশি নিজ দেশের জনগণ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও পার্লামেন্টে এই বিতর্কিত পরিবর্তন অনুমোদন পায়।

জাপানের সামরিক বাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধন করার তার বৃহত্তর লক্ষ্য অসম্পূর্ণ থেকে গেছে এবং দেশটিতে এটি একটি বিভাজন তৈরিকারী বিষয় হয়ে বহাল রয়েছে। এছাড়া তার আরেক অপূর্ণ ইচ্ছা হলো উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা ফিরে পাওয়া। বিতর্কিত এই দ্বীপাঞ্চল নিয়ে জাপান ও রাশিয়ার বিরোধ রয়েছে।

২০১২ সালে বিতর্কিত স্মৃতিসৌধে আবে

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আবের সখ্যতার কারণে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাণিজ্য শুল্কের বোঝা থেকে রক্ষা পায় জাপান। এছাড়া জাপানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির জন্য আরও বেশি অর্থ আদায়ের জন্য কৃতিত্ব পেয়ে থাকেন আবে।

অর্থনীতি এবং কোভিড-১৯ সামাল

‘আবেনোমিকস’ নামে পরিচিত আবের নিজস্ব অর্থনৈতিক নীতি। এই নীতির কারণেই তার প্রথম মেয়াদে অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকা সচল হয়।

তার এই নীতির মধ্যে ছিল সুদের হার কমিয়ে ভোক্তা ও কোম্পানিগুলোকে ঋণ নেওয়া ও ব্যয়ের সুযোগ বাড়ানো, অবকাঠামো ও প্রণোদনায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, শ্রমশক্তিতে আরও বেশি নারীকে যুক্ত করা এবং কাজের চাপ কমাতে বেশি অভিবাসী শ্রমিক নেওয়া। এসব নীতির কারণে দ্রুত সচল হয় অর্থনীতি।

অর্থনৈতিক জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবে

তবে তার উদ্যোগ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ২০২০ সালে। ওই বছরের বসন্তে জাপানে ফের মন্দা শুরু হয়। এতে তার উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

এর মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে আবের জনপ্রিয়তা আরেক দফা ধাক্কা খায়। সমালোচকদের বিশ্বাস অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাড়াতে আবের প্রচারণা সংক্রমণ বাড়াতে সহায়তা করেছে। তারা আরও বলে থাকেন ‘আবেনোমিকস’ এর অন্য প্রতিশ্রুতিগুলো যেমন, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বজনপ্রীতি মোকাবিলা, অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ বদলানো বাস্তবায়ন- অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।

আন্তর্জাতিকভাবে আবে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ গড়ে তোলার কৃতিত্ব পেয়ে থাকেন। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ১১ দেশের এই বড় বাণিজ্য চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলে তা টিকিয়ে রাখার কৃতিত্ব পান আবে।

পদত্যাগ ও মৃত্যু

২০২০ সালের ২৮ আগস্ট আবে পদত্যাগের ঘোষণা দিলে এলডিপির অভ্যন্তরে বিরোধ শুরু হয়। এর কারণ তিনি কোনও উত্তরসূরির নাম ঘোষণায় অস্বীকৃতি জানান। পরে তার দায়িত্ব পান বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও দীর্ঘকালের ক্যাবিনেট সদস্য ইয়োশিদি সুগা। পরে তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। তখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন আবে।

ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিলো আবের

৮ জুলাই আবে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নারাতে এলডিপির এক প্রার্থীর নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিচ্ছিলেন। তার বক্তব্য চলার মাঝে এক বন্দুকধারী তার ওপর গুলি চালায়। ৪১ বছর বয়সী হামলাকারী জাপানের সেলফ-ডিফেন্স ফোর্সের সাবেক সদস্য। এই বাহিনী জাপানের নৌবাহিনীর সমমর্যাদা পেয়ে থাকে।

আবেকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হয়, তখনও তার জ্ঞান ছিল। কিন্তু চিকিৎসকদের সাড়ে চার ঘণ্টার টানা চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মৃত্যু হয় তার।

সূত্র: বিবিসি