অস্ত্রচুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর সিরিয়া ও রাশিয়া যৌথভাবে আলেপ্পোতে হামলা ও অভিযান জোরদার করায় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সিরিয়ানীতি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এদিকে, সিরিয়ার হামলায় আলেপ্পোর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। পানির অভাবে দুর্ভোগের পড়েছেন শহরটির বাসিন্দারা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সিরীয় সেনাবাহিনী আলেপ্পোতে নতুন অভিযান ঘোষণা দেওয়ার পর শনিবার প্রথমবারের মতো সফলতার মুখ দেখে সিরিয়া। শনিবারই আক্রমণাত্মক অভিযানে অগ্রসর হয়েছে হান্দারাত ক্যাম্প দখল করে সিরীয় বাহিনী। শহরটির অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করতো বিদ্রোহীরা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, যুদ্ধবিমান থেকে মুহূর্মুহ হামলার ঘটনা ঘটেছে। হান্দারাত শহরটি বেশ কয়েক বছর ধরে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। শনিবার সিরীয় বাহিনী অগ্রসর হওয়ার পথে একটি ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরও পুনর্দখল করে। আলেপ্পো যাওয়ার একটি প্রধান সড়কও দখল করে আসাদবাহিনী।
হান্দারাত হাতছাড়া হওয়ার কথা জানিয়েছেন এক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কর্মকর্তাও। সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অভিযানে ‘বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে’।
গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আলেপ্পো
নতুন অভিযান শুরুর পর আলেপ্পোর পূর্বাঞ্চলে অনেক নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অস্ত্রচুক্তি নিয়ে আলোচনাকেও কবর দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি রাশিয়ার সঙ্গে এ সপ্তাহে বৈঠকে বিমান হামলা বন্ধের আহ্বান জানান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এ আহ্বান অগ্রাহ্য করেছে রাশিয়া।
অস্ত্রবিরতি চুক্তির ভেঙে পড়া এবং বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আসাদ সরকারের সর্বাত্মক হামলা চালানোর সিদ্ধান্তকে সংঘর্ষ কবলিত অঞ্চলটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গত ছয় বছরের তুলনায় এবারই প্রথম শক্তি প্রদর্শণের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের উৎখাত ও দমনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আসাদ।
আলেপ্পোর পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, যে কোনও সময়ের তুলনায় বিমান হামলা জোরদার হয়েছে এবং আগের চেয়ে শক্তিশালী বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কর্মকর্তা জানান, শনিবার এ অঞ্চলের অন্তত চারটি এলাকায় বিমান হামলা হয়েছে। বিদ্রোহীদের মতে রাশিয়ার যুদ্ধবিমান থেকেই বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। হামলার ভিডিওতে দেখা যায়, বোমা নিক্ষেপের আঘাতে সৃষ্ট গর্ত অনেক গভীর ও আঘাতের ব্যাপ্তি অনেক ছড়ানো।
পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পোতে প্রায় আড়াই লাখ বেসামরিক মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। গত কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ার সবচেয়ে বড় এ শহর বিদ্রোহী ও সরকারিবাহিনী দুই ভাগে ভাগ করে নিয়ন্ত্রণ করছে। সিরীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা শুধু সশস্ত্র যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে।
শনিবার সকালে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পোর পূর্বাঞ্চলের সিভিল ডিফেন্স প্রধান আম্মার আল সেলমো বলেন, এখন আকাশে শুধু যুদ্ধ বিমান। তিনি জানান, অ্যাম্বুলেন্স ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে বোমার আঘাতে ধ্বংসস্তুপ থেকে জীবিতদের উদ্ধার ও মরদেহ খুঁজে বের করে সমাহিত করা হচ্ছে। তাদের অনেক দফতরও হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের পথে আসাদবাহিনী
সিরিয়া সরকার ও তার সমর্থক যেমন ইরান, ইরাক ও লেবাননের শিয়া মিলিশিয়ারা এ বছরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো শহর ঘিরে রাখে। রাশিয়ার বিমান হামলার সহযোগিতায় এই গ্রীষ্মের আগেই বিদ্রোহীদের দখলমুক্ত করার উদ্দেশ্যেই আলেপ্পোকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
আলেপ্পোতে সরকার সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার রয়টার্সকে বলেন, তাদের লক্ষ্য এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো আলেপ্পো দখল করা।
শুক্রবার এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছিলেন, সিরিয়া সরকারের পক্ষে পুরো আলেপ্পো দ্রুত দখলের একমাত্র উপায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো। তিনি বলেন, এটা হবে এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ যা আগামী কয়েকটি প্রজন্ম ঘৃণাভরে স্মরণ করতে বাধ্য হবে।
সিরিয়ার এক সামরিক সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ঘোষিত অভিযান পরিকল্পনা মতোই এগুচ্ছে। এর বেশি কিছু জানাতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। শুক্রবার ওই সূত্র জানায়, অভিযান আরও কয়েকদিন চলবে।
কী ধরনের অস্ত্র সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে জানতে চাইলে ওই সূত্র জানায়, বিদ্রোহীদের অবস্থান ও হামলার লক্ষ্যবস্তু অনুসারে উপযুক্ত অস্ত্র ব্যবহার করছে সেনারা। বিশেষ করে সুড়ঙ্গ, বাংকার ও কমান্ড সেন্টারের ক্ষেত্রে।
আলেপ্পোভিত্তিক বিদ্রোহীদের একটি গ্রুপ লেভান্ত ফ্রন্ট-এর এক শীর্ষ কর্মকর্তা রয়টার্স জানান, সিরীয় সেনারা যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে তা এমনভাবে তৈরি করা যাতে একটি পুরো ভবন ধসে পড়ে। তিনি বলেন, বেশির ভাগ হামলার শিকার মানুষ ভবনের ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে আছেন। কারণ বেসামরিক প্রতিরক্ষা সেবা অর্ধেকেই কাজ করতে পারছে না।
ব্রিটেনভিত্তিক দ্য সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস সংস্থা জানায়, শুক্রবার থেকে শনিবার পর্যন্ত তারা ৭২জন নিহতের তালিকা করেছেন। এর মধ্যে ৫ শিশুও রয়েছেন। তবে শহরটির বেসামরিক প্রতিরক্ষা সেবার পক্ষ থেকে নিহতের সংখ্যা শতাধিক বলে দাবি করা হয়েছে।
বন্ধ আলেপ্পোর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা
জাতিসংঘ জানিয়েছে, সিরিয়ার নতুন করে শুরু করা হামলায় আলেপ্পোর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পানি না থাকায় শহরের অবরুদ্ধ প্রায় আড়াই লাখসহ পুরো আলেপ্পোর কয়েক লাখ মানুষ প্রচণ্ড দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, তীব্র বোমা হামলার ফলে শহরের একটি পাম্পিং স্টেশনের মেরামত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ওই স্টেশন থেকে শহরের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো পানি সরবরাহ করা হতো। এর প্রতিশোধ হিসেবে শহরের অন্যান্য অংশের পানি সরবরাহের পাম্প স্টেশনগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কার্যত পুরো আলেপ্পোই এখন পানিবিহীন হয়ে পড়েছে।
ইউনিসেফের ডেপুটি ডিরেক্টর জাস্টিন ফরসিথ বলেন, 'বিশ্বের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে আলেপ্পো। বোমা মেরে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আলেপ্পোয় অমানবিকতার সর্বশেষ ঘটনা এটি।'
পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফল মারাত্মক হতে পারে বলে ইউনিসেফ কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন। বাধ্য হয়ে শহরের বাসিন্দাদের দূষিত পানি পান করা লাগতে পারে। এতে কেরে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন আলেপ্পোবাসী।
চলছে রুশ-মার্কিন বাহাস
আলেপ্পোয় যখন রুশ-সিরিয়ার সম্মিলিত অভিযানে ধ্বংসযজ্ঞ ও বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ঘটছে তখনও অস্ত্রবিরতি ভেঙে যাওয়া নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।
আলেপ্পোতে নতুন অভিযানের পর শুক্রবার জাতিসংঘে দেওয়া বক্তব্যে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, সিরিয়ায় সংঘাত বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পরিকল্পনা অবশ্যই টিকিয়ে রাখতে হবে। এর বিকল্প আর কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটন ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।
লাভরভ বলেন, অস্ত্রবিরতির একটি শর্ত ছিল, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত মধ্যপন্থী বিদ্রোহী সংগঠনগুলো জঙ্গিদের গ্রুপ থেকে নিজেদের আলাদা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট জঙ্গিদের সঙ্গ ত্যাগ করতে অঙ্গীকার করেছিল। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, তার ‘ভাল বন্ধু’ জন কেরি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখনও এই অঙ্গীকার রক্ষার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, লাভরভের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে এবং সিরিয়া বিষয়ে মতভেদ নিরসনে ‘সামান্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা গঠনমূলক উপায়ে পারস্পরিক ধারণা ও মতামত বিশ্লেষণ করছি।’
সিরিয়ায় ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে আড়াই লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার দাবি। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। সিরিয়ার চলমান সংকট নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিপরীত ধর্মী। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য তারা আসাদ সরকারের বিদ্রোহ ঘোষণাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে এবং ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালাচ্ছে। তবে আসাদ সরকারের দাবি, আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র মূলত বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করতে সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে। আর রাশিয়া বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। আসাদ সরকারের সমর্থনে রাশিয়াও আইএস ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালাচ্ছে। সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ছায়া যুদ্ধে মেতে ওঠেছে বলে অনেকেই মনে করেন। সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স।
/এএ/বিএ/