সম্প্রতি ইসরায়েলকে ইহুদিদের জাতি-রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে যে আইন পাস করা হয়েছে তার সমালোচনায় মুখ খুলেছেন বুদ্ধিজীবীরা। ওই আইনকে ‘উস্কানিমূলক’ ও ‘বর্ণবাদী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলেছেন, ইসরায়েলের ‘জাতি রাষ্ট্রের’ আইনটির কারণে দেশটির সামাজিক গঠনে গভীর প্রভাব পড়বে। সেখানে বসবাসরত অইহুদি আরবীয়রা আইনটির কারণে প্রান্তিক হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ বিষয়ে ইসরায়েলি লেখক, মার্কিন ইতিহাসবেত্তা, খ্রিস্টান যাজক, ইসরায়েলি সাংবাদিক এবং ইসরায়েলের আরব বংশোদ্ভূত সংসদ সদস্যের বক্তব্য তুলে ধরেছে।
ইসরায়েলের সংসদে ‘জাতি রাষ্ট্রের’ আইনটি পাস হয়েছে ৬২ ভোটে। প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে ভোট ছিল ৫৫টি। বৃহস্পতিবার এই ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। নতুন পাস হওয়া আইনে আরবির সরকারি মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আরবিকে দেওয়া হয়েছে ‘বিশেষ মর্যাদা।’ হিব্রুই এখন ইসরায়েলের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আইনে আরও বলা হয়েছে, ‘ল্যান্ড অফ ইসরায়েল ইহুদিদের আবাসভূমি।’ অথচ ল্যান্ড অফ ইসরায়েল বলতে ঐতিহাসিকভাবে যতখানিক এলাকা ফিলিস্তিনের মধ্যে ছিল তার সবটুকুকে বোঝায়। প্রথমত, সেখানে শুধু ইহুদিরা থাকেন না, মুসলমান ও খ্রিস্টানরাও থাকেন। আইনের এই ভাষার কারণে একদিকে ইসরায়েলে থাকা মুসলমান ও খ্রিস্টানরা বাদ পড়ে গেলেন। কারণ ইসরায়েলকে ‘ইহুদিদের আবাসভূমি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, সমগ্র ফিলিস্তিনের এলাকা বোঝাতে যে ‘ল্যান্ড অফ ইসরায়েল’ বলা হয় তাকে ইহুদিদের আবাসভূমি বলার মাধ্যমে বর্তমান ফিলিস্তিনে থাকা মুসলমানদের স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশাকেও প্রান্তিক করে দেওয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, ‘ইহুদিদের আবাসভূমি স্টেট অফ ইসরায়েল বাস্তবায়িত হওয়ার মাধ্যমে ইহুদিদের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।’
এই জাতি রাষ্ট্রের আইনে ইহুদি পরিচয়কে মুখ্য হিসেবে চিহ্নিত করায় দেশটিতে থাকা আরবীয়দের ‘স্থায়ী বিদেশিতে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ক্ষুণ্ন হয়েছে ইসরায়েলের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। বিরোধীরা বলছেন, ওই আইনের কারণে ধীরে ধীরে ইসরায়েলে থাকা মুসলমান ও খ্রিস্টান আরবীয়দের অধিকার ক্ষীণ হতে থাকবে। আর ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন ও ‘টু স্টেট সলিউশনের’ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়েক ফরেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের’ জিউইশ হিস্টোরির প্রধান ব্যারি ট্রাচটেনবার্গ মন্তব্য করেছেন, ‘এই আইনের কথা জনার পর আমার মনে হয়েছে, খুব বেশি দিন আগের কথা নয় যখন ইহুদিদের বিরুদ্ধেই এমন আইন পাস করা হতো। এই আইন গত শতকে ইহুদিদের দুরবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ শতকের শুরুতে ইহুদিরা ইউরোপের যেসব দেশে বসবাস করত, সেসব দেশের কাছে তারা তাদের আত্মপরিচয়ের আইনি সুরক্ষা দাবি করেছিল। তারা চেয়েছিল, তাদেরকে যেন আইনগতভাবে সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর আজ তারা ঠিক উল্টো আইন পাস করিয়েছে।’
ট্রাচেনবার্গ আশঙ্কা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন, যেসব স্থানে এমন আইন বলবতের চেষ্টা করা হয়েছে সেসব স্থানের পরিস্থিতি পরবর্তীতে একঘরে করে দেওয়া, বর্ণবাদ, নিপীড়ন, গণগ্রেফতার এবং জাতিগত নিধনের মত ঘটনার দিকে প্রবাহিত হয়েছে, ‘যে দেশে আইনগতভাবে একজন নাগরিককে অপরের ওপর স্থান দেওয়া হয় সেখানে সমতা নিশ্চিত করা অসম্ভব।’
ইসরায়েলি সাংবাদিক সেথ ফ্রাঞ্জম্যান আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘ইসরায়েলের আরবীয় নাগরিকরা ওই আইন নিয়ে নিজেদের অনাস্থা প্রকাশে সোচ্চার হলেও সাধারণ ইহুদিদের এ বিষয়ে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। তাদের জন্য এটা নতুন বিষয় নয়। ওই আইনে যা নিশ্চিত করা হয়েছে তা ইসরায়েলি ইহুদিরা বহুদিন ধরেই ভোগ করে আসছে। ওই আইন তাদেরকে নতুন কিছু এনে দেয়নি।’
সাবেক আর্চবিশপ এবং জেরুজালেমের ল্যাটিন প্যাট্রিয়ার্ক মাইকেল সাবাহ আইনটিকে ‘বর্ণবাদী’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এতে তিনি বিস্মিত হননি। কারণ তার দৃষ্টিতে ইসরায়েলের বর্তমান নেতৃত্ব চরমপন্থী। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ওই আইন আরবীয় অইহুদিদের বিরুদ্ধে রচিত বড় ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক পদক্ষেপ। তভে তিনি আশা ক্র্যাব, ভবিষ্যতে উদারপন্থীরা ক্ষমতায় এলে আইনটি রদ হয়ে যাবে।