সাদ্দাম নেই, তবু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিখোঁজ ইরাকে

ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৌশলী হাজেম মোহাম্মদের মনে কিছুটা আশা জেগেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, এবার হয়তো নিজের ভাইয়ের সন্ধান পাবেন তিনি। ১৯৯১ সালে সাদ্দামের শাসনের বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিদ্রোহের পর গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তাকে। পরে মরদেহ একটি গণকবরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

২০০৩ সালের মার্চে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর মোহাম্মদের মতো অনেকেই আশা করেছিলেন যে স্বৈরশাসকের অধীনে নিহত বা নিখোঁজ হওয়া কয়েক হাজার মানুষের হদিস তারা শিগগিরই পাবেন।

২০ বছর কেটে গেলেও মোহাম্মদের আশা মেটেনি। সেদিন মোহাম্মদকেও গুলি করা হয়েছিল তার ভাইয়ের সঙ্গে। দুটা গুলি লাগলেও ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ। তার মতো অগণিত ইরাকি তাদের নিহত বা নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে আজও অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।

ইরাকে সন্ধান মেলা কয়েক ডজন গণকবর সাক্ষ্য দিচ্ছে সাদ্দামের বাথ পার্টির অধীনে সংঘটিত নৃশংসতার। তবে গত দুই দশকে হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজ খুব একটা এগোয়নি।

মোহাম্মদ বলেন, ‘গণকবর খুব বাজেভাবে খোঁড়া হচ্ছিল। অনেকটা এলোমেলোভাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমার বিষয়টি গোপন রাখব। দেশে স্থিতিশীলতা না ফেরা পর্যন্ত চুপ থাকব।’

এই বিশ বছরের আইএস, আল কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠনের হামলা ও  সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে আরও অনেক ইরাকির মৃত্যু হয়েছে। শিয়া মুসলিম মিলিশিয়ারাও এসবে পিছিয়ে নেই।  

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রসের মতে, ইরাকে আজ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নিখোঁজ ব্যক্তি রয়েছে। সংখ্যাটা কয়েক লাখ পর্যন্ত হতে পারে।

১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের শেষে সাদ্দামের সেনারা ইরাকের শিয়াদের ওপর হামলে পড়ে। মোহাম্মদ ও তার ভাইকে যেখানে গুলি করা হয়, ১০ বছর আগে সে স্থানে অভিজ্ঞ দল নিয়ে অভিযান চালান মোহাম্মদ। জায়গাটি দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নাজাফের উপকণ্ঠে।

সেই গণকবর থেকে ৪৬ জনের দেহাবশেষ উত্তোলন করা হলেও, মোহাম্মদের ভাইকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মোহাম্মদ বিশ্বাস করেন, আরও অনেক মৃতদেহ এখনও সেখানে রয়েছে, যার হিসেব নেই।

মোহাম্মদ বলেন, ‘যে দেশ তার অতীত নিয়ে কাজ করে না, সেদেশ বর্তমান বা ভবিষ্যত মোকাবিলা করতে পারবে না।’

 

বেদনাদায়ক অগ্রগতি

নিহতদের শনাক্তকরণ এবং তাদের আত্মীয়দের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য একটি সরকারি সংস্থা কাজ করছে বলে জানিয়েছে শহীদ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা। তারা এ পর্যন্ত ২৬০টির বেশি গণকবর খুঁজে পেয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় অর্থ আর দক্ষ লোকবলের অভাবে বড় পরিসরে কাজ এগোচ্ছে না।

সংস্থার বিভাগীয় প্রধান ইয়াসমিন সিদ্দিক বলেন, ‘প্রায় চার হাজার ৫০০টি উত্তোলিত লাশের মধ্যে প্রায় ডিএনএ পরীক্ষা করে ২ হাজার মানুষের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে।'

ইয়াসমিন সিদ্দিক যে কক্ষে বসেন সেখানের তাকে রাখা আছে ১৯৮০-৮৮ সালে সংগঠিত ইরাক-ইরান যুদ্ধে নিহত বা নিখোঁজদের ধ্বংসাবশেষ।

শহীদ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা মেহেদি ইব্রাহিম বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে আমরা প্রায় ২০০ জনকে শনাক্ত করি। তারপর নামগুলো সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ করি।’

 

কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত পরীক্ষা করা হয়

ইয়াসমিন সিদ্দিক বলেন, ‘২০১৪ সালে উত্তর ইরাকের বেশিরভাগ অংশ দখল করে নিয়েছিল আইএস। তিন বছরে তারা দেশটিতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। জঙ্গিদের হাতে নিহত বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।’

সবচেয়ে বেশি মরদেহ শনাক্ত হয়েছে ক্যাম্প স্পিচার গণহত্যা নামে পরিচিত একটি ঘটনায়। জঙ্গিরা সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্তদের গুলি করে সেখানে হত্যা করে।

শহীদ ফাউন্ডেশন বলছে, এই ঘটনায় প্রায় ২ হাজার মানুষ ভুক্তভোগী হয়েছেন। তাদের মধ্যে যার মধ্যে ১২০০ জন নিহত এবং ৭৫৭ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

সিনজারে ইয়াজিদি সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে আইএস। জাতিসংঘ বলছে, সিনজারের বিভিন্ন গণকবর থেকে ৬০০ জনের মরদেহ তোলা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৫০ জনকে শনাক্ত করা গেছে।

সুন্নি অধ্যুষিত ফালুজার শহরের কাছের একটি গ্রামীণ এলাকা সাকলাউয়া। আইএসের কাছ থেকে শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর অন্তত ৬০০ পুরুষকে ধরে নিয়ে যায় শিয়া মিলিশিয়ানরা। এখনও তাদের পথ চেয়ে বসে আছে স্বজনরা।  

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ২০১৬ সালে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শিয়া মিলিশিয়ানরা সাকলাওয়াইয়া শহরের সুন্নিদের ধরে নিয়ে যায়।

সাকলাভিয়ার বাসিন্দা ইখলাস তালালের স্বামীকেও সেবার ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বামীর ছবি আঁকড়ে হু হু করে কাঁদছিলেন তিনি।       

 

‘আমাদের কোনও মূল্য নেই’

যারা স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের চেনেন তালাল। তবে প্রতিশোধের ভয়ে তাদের নাম মুখে আনেন না তালাল। শহরের আরও কয়েকজনের সঙ্গে ইরাকের বিভিন্ন হাসপাতাল, কারাগারে স্বামীকে খুঁজে বেড়ান তিনি।   

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আহমেদ বেঞ্চেমসি বলেন, ‘ইরাকি সরকারকে অবশ্যই নিখোঁজদের খুঁজে বের করতে হবে। অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সব পদক্ষেপ নিতে হবে।’

শহীদ ফাউন্ডেশন এবং ইরাকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাকলাওয়াইয়া মামলার বিষয়ে মন্তব্য করার অনুরোধের জবাব দেয়নি। সূত্র: রয়টার্স ইরাকে