গাজায় আগ্রাসনের ৬ মাসে কতটা বিচ্ছিন্ন হলো ইসরায়েল?

গাজায় প্রায় ছয় মাস ধরে আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েল। সম্প্রতি দেশটির সেনাবাহিনীর হামলায় কয়েকজন ত্রাণকর্মী নিহতের ঘটনায় সেখানকার মানবিক সংকট ও সংঘাত অবসানের স্পষ্ট রূপরেখা না থাকায় ক্রমশ বিশ্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে ইসরায়েল। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এমন পরিস্থিতি উঠে এসেছে।

সোমবার রাতে ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন (ডব্লিউসিকে) ত্রাণ গোষ্ঠীর সাত কর্মী নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছয় বিদেশি নাগরিক ছিলেন। এর মধ্যে কয়েকজন ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের নাগরিক। এর ফলে গাজায় লড়াই অবসানে চাপ জোরালো হচ্ছে।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে ভুল করে হামলা চালানো হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ঘটনার জন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে। নিহতদের মধ্যে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড ও কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের একজন দ্বৈত নাগরিক ছিলেন।

তবে এতে করে বিশ্বে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ কমেনি। সাধারণভাবে ব্রিটেন, জার্মানি বা অস্ট্রেলিয়ার জনগণের সমর্থন ইসরায়েলের পক্ষে থাকলেও এখন গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জবাবে শুরু করেছিল ইসরায়েল।

গাজায় সংঘাত বন্ধে নিজের সমর্থকদের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ত্রাণ বহরে হামলায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাইডেনের ফোনালাপের পর হোয়াইট হাউজ বেসামরিকদের ক্ষতি এড়াতে নির্দিষ্ট ও পরিমাপযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ইসরায়েলের কাছে দাবি জানিয়েছে এবং বলেছে, ইসরায়েলের পদক্ষেপের ওপর ভবিষ্যৎ সহযোগিতা নির্ভর করবে।

ত্রাণ প্রবেশের সুযোগ বাড়ছে

শুক্রবার নেতানিয়াহু উত্তর গাজায় এরেজ ক্রসিং পুনরায় উন্মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সাময়িকভাবে দক্ষিণ ইসরায়েল আশদদ বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া হবে। এছাড়া দক্ষিণ গাজার কারমেন শালম ক্রসিং দিয়ে জর্ডানের ত্রাণ সুযোগও বাড়ানো হবে।

ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। উপত্যকার ২৩ লাখ জনগোষ্ঠী নিজেদের বাড়ি উচ্ছেদ হয়েছেন বাধ্য হয়ে। এখন তাদের টিকে থাকা নির্ভর করছে ত্রাণের ওপর। পবিত্র রমজান মাসে এমন পরিস্থিতি ফিলিস্তিনিদের আরও অপমানজনক। সাধারণভাবে মুসলিমরা রমজান মাসে ইফতার ও সেহরি খেয়ে থাকেন।

পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফা শহরে অবস্থান করছেন ৩৩ বছর বয়সী উম নাসের দাহমান। এই রাফাতে এখন গাজার অর্ধেক বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছেন। দাহমান বলেছেন, রমজান শুরুর আগে আমাদের কিছু আশা ছিল, কিন্তু প্রথম রোজাতে তা হারিয়ে গেছে। যুদ্ধের আগে অবস্থা ভালো ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর আমাদের ত্রাণ ও আত্মীয়দের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

ত্রাণ বহরে হামলার আগে থেকেই কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল ইসরায়েল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের একাধিকবার মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়াতেও চাপে ছিল দেশটি। বিশেষ করে ত্রাণ গোষ্ঠীগুলো সেখানে দুর্ভিক্ষ আসন্ন বলে আশঙ্কার পর চাপ জোরালো হয়েছে।

ইসরায়েল দাবি করেছে কয়েক হাজার হামাস যোদ্ধা ও লড়াইয়ের ইউনিট ধ্বংস করেছে। কিন্তু ছয় মাস পরও ইসরায়েলি সেনারা উত্তর ও মধ্য গাজায় লড়াই করছে। এই এলাকাগুলোতে যুদ্ধের শুরুতে অভিযান চালিয়েছিল ইসরায়েল।

তবে এখন পর্যন্ত চাপ উপেক্ষা করে নিজের লক্ষ্যে অটল রয়েছেন নেতানিয়াহু। তার দাবি, ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হামাস হুমকি এবং দীর্ঘ শান্তি স্থাপনের পূর্বে হামাসকে ধ্বংস করতে হবে।

বৃহস্পতিবার জেরুজালেমে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের কংগ্রেস সদস্যদের একটি প্রতিনিধিদলকে বলেছেন, জয় বেশি দূর নয় এবং জয়ের কোনও বিকল্প নেই। বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপের কয়েক ঘণ্টা পূর্বে নেতানিয়াহু তাদের কাছে আরও আর্থিক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।

চক্রের পুনরাবৃত্তি

হামাসকে ধ্বংস ও গাজায় থাকা ১৩৪ জিম্মিকে ফেরত আনার লক্ষ্যের প্রতি ইসরায়েলি জনগণের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও নতুন নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে। একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচন হলে নেতানিয়াহু বড় ব্যবধানে হারবেন।

৭৩ বছর বয়সী লেখক ও জেরুজালেমের একটি স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা ওয়েন্ডি ক্যারল বলেছেন, বাইরে থেকে যারা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছেন তারা ইসরায়েলের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারছেন না বলে আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি।

তবে তিনি বলেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বাস করি না। তিনি দেশকে বিভক্তকারী শক্তি এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষও এমনটি মনে করেন।

শান্তি আলোচনা চলমান রয়েছে। তবে লড়াইয়ে বিরতি ও জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আলোচনায় বড় অগ্রগতির আশাবাদ বারবার ফিকে হয়েছে। হামাস নেতারা দাবি করে আসছেন, তারা দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে।

সিনিয়র হামাস নেতা সামি আবু জুহরি বলেছেন, ছয় মাস কেটে গেছে এবং আল কাসেম ব্রিগেড এখনও জায়নবাদী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১২০০ জন নিহত ও আড়াই শতাধিক ব্যক্তিকে গাজায় জিম্মি করে নিয়ে যাওয়ার পর এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ইসরায়েলের ইতিহাসে ৭ অক্টোবরের হামলায় নিহতের সংখ্যা এক দিনে সর্বোচ্চ নিহতের ঘটনা। জবাবে গাজায় যে আগ্রাসন শুরু করেছে ইসরায়েল তা আরও বেশি রক্তক্ষয়ী। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, বৃহস্পতিবার নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে।

হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলায় ইসরায়েলের প্রায় ৩৫০ সেনা নিহত হয়েছিলেন। আর গাজায় অভিযানে নিহত হয়েছেন আরও আড়াই শতাধিক সেনা।

ফিলিস্তিনিদের নিহতের পরিসংখ্যানে বেসামরিক ও যোদ্ধাদের আলাদা সংখ্যা বলা হয় না। ইসরায়েলের দাবি, তারা হামাসের ১০ হাজারের বেশি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তবে হামাস তা প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, নিহতদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিশু।

গাজায় হতাহতের তীব্রতা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এবং সংঘাত বন্ধের দাবি উঠেছে। কিন্তু গাজাবাসীর অপেক্ষা এখনও শেষ হয়নি। কবে হবে তা অনিশ্চিত।

উম নাসের দাহমান বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি সবকিছুর শেষ আছে, যুদ্ধও শেষ হবে। কিন্তু কখন?