লেবাননে কেন সেনা পাঠাচ্ছে ইসরায়েল?

ইসরায়েল সম্প্রতি দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সীমিত সামরিক অভিযান শুরু করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এই অভিযানের উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ লেবাননের সেই অঞ্চল থেকে হিজবুল্লাহর শক্তি দুর্বল করা। তাদের দাবি, এসব এলাকা থেকে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে।

হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে এর আগে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। সর্বশেষ ২০০৬ সালে মাসব্যাপী যুদ্ধের পর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। ওই সময় উভয়পক্ষকে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তের ২০ মাইল অঞ্চলে সেনা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে হিজবুল্লাহ ওই অঞ্চল থেকে কখনও সরে যায়নি। আর ইসরায়েলি বাহিনী সোমবার রাতে সেই অঞ্চলে প্রবেশ করে।

ইসরায়েলের লক্ষ্য কী?

মঙ্গলবার সকালে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। বিশেষত, তারা সেই এলাকাগুলো লক্ষ্য করেছে, যেখান থেকে হিজবুল্লাহ সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে।

গত দুই সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি বিমান হামলা ও বিভিন্ন হামলা হিজবুল্লাহর ওপর চালানো হয়েছে। এসবের উদ্দেশ্য ছিল তাদের নেতৃত্বকে দুর্বল করা। বিশেষ করে, শুক্রবারের এক বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হন। তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ভাষ্যমতে, এই হামলাগুলো হয়তো স্থল অভিযান এড়াতে সাহায্য করবে।

দক্ষিণ লেবাননকে কেন লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে?

দক্ষিণ লেবাননের ভূ-প্রকৃতি আক্রমণকারীদের জন্য কঠিন। পাহাড়ি উপত্যকা ও খাড়াই এলাকা হিজবুল্লাহর জন্য সুবিধাজনক অবস্থান। সেখানে তারা সহজে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী কয়েক মাস ধরে সেই এলাকায় অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে।

ইসরায়েলি বাহিনী কতদূর পর্যন্ত দক্ষিণ লেবাননে প্রবেশ করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে মঙ্গলবার সকালে ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা ১৫ মাইল দূরে অবস্থিত আউয়ালি নদীর উত্তরের প্রায় ২০টি শহর ও গ্রাম খালি করার নির্দেশ দিয়েছে।

জাতিসংঘের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাব কী বলছে?

২০০৬ সালে যুদ্ধ শেষ করার জন্য জাতিসংঘের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাব পাস হয়। এতে ইসরায়েলি বাহিনীকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, হিজবুল্লাহকেও উত্তরের লিতানি নদীর ওপারে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে সেই নির্দেশনা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন কখনও হয়নি।

হিজবুল্লাহ দাবি করে, ইসরায়েল এখনও লেবাননের ভূমি দখল করে রেখেছে। বিশেষ করে শেবা ফার্মস এলাকা, যা জাতিসংঘ সিরিয়ার অংশ বলে স্বীকৃতি দিলেও লেবানন এবং হিজবুল্লাহ এটিকে লেবাননের অংশ বলে দাবি করে।

প্রস্তাবে হিজবুল্লাহর নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে তারা আরও সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে। ইসরায়েল মনে করে, হিজবুল্লাহ নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। ২০১৮ সালে ইসরায়েলের এক সামরিক অভিযানে হিজবুল্লাহর কয়েকটি সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছিল।

ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ উত্তেজনার সর্বশেষ পরিস্থিতি

ইসরায়েল বহুদিন ধরে আশঙ্কা করেছিল যে হিজবুল্লাহ গাজার হামাসের মতোই বড় আকারের হামলা চালাতে পারে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল, যা গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিল।

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলার পরও হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় বিভিন্ন এলাকায় রকেট হামলা অব্যাহত রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হিজবুল্লাহর হাতে সম্ভবত বিশ্বের একটি বড় অস্ত্রভাণ্ডার রয়েছে। তাদের কাছে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট থাকতে পারে।

ইসরায়েলের যুক্তি ও শঙ্কা

ইসরায়েল মনে করে, হিজবুল্লাহর সশস্ত্র উপস্থিতি ইসরায়েলের জন্য একটি বড় হুমকি। তারা জাতিসংঘকে ১৭০১ নম্বর প্রস্তাব কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে এবং লেবানন থেকে হিজবুল্লাহর সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের দাবি করছে।

হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি এবং ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করেছে। এই সংঘাত কতদূর গড়াবে, তা স্পষ্ট নয়। তবে এটি স্পষ্ট যে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে উত্তেজনা যেকোনও মুহূর্তে আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে।

সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস