ইসরায়েলের ধারাবাহিক বিমান হামলায় যখন ইরানের নিরাপত্তা কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত, তখনই ইরানের বিচ্ছিন্ন ও নির্বাসিত বিরোধী দলগুলো সরকারের পতন ঘটাতে গণআন্দোলনের ডাক দিচ্ছে। তবে যেসব অ্যাক্টিভিস্ট অতীতে তীব্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা এখনই রাস্তায় নামতে অনিচ্ছুক। তাদের ভাষায়, ইরান এখন বিদেশি হামলার শিকার এবং এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জনগণের প্রধান চিন্তা হচ্ছে পরিবার, প্রতিবেশী, এমনকি পোষা প্রাণীগুলোকেও রক্ষা করা। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে আছে ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা, এমন অভিমত অনেক বিশ্লেষকের। সেই বাস্তবতায় নির্বাসিত বিরোধীরা বলছেন, এই মুহূর্তটাই তাদের জন্য সুযোগ।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ইরানের সাবেক শাহ রেজা পাহলভীর পুত্র রেজা পাহলভী বলেন, এটাই আমাদের ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমি রাজনৈতিক রূপান্তরের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র উৎখাতের পক্ষে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হিসেবে এই সময়কে বর্ণনা করেন।
অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও ইরানিদের উদ্দেশে সরাসরি ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা শুধু হামলা করছি না, আপনাদের স্বাধীনতার পথও প্রশস্ত করছি।
তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে, ইরানের ভেতরে এই ডাক কতটা বাস্তবায়নযোগ্য? যেকোনও শাসনের বিরুদ্ধে সফল চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে হলে জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আর তা আদৌ এখন সম্ভব কিনা—তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দি ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠছে বলে ধারণা করা হলেও দেশজুড়ে গণআন্দোলনের কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যায়নি। তেহরান, কোম ও অন্যান্য শহরে সরকারবিরোধী কোনও বিশাল জমায়েত এখনও হয়নি।
ইরানে বাসিজ মিলিশিয়ার সদস্য মোহাম্মদ আমিন জানান, ইসরায়েলি গুপ্তচরদের ধরতে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করতে তার ইউনিটকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে।
ছয় বছর কারাভোগের পর দেশ ছেড়ে যাওয়া অধিকারকর্মী আতেনা দাইমি বলেন, এই অবস্থায় মানুষ কীভাবে রাস্তায় নামবে? এখন মানুষ শুধু নিজেদের ও পরিবারকে বাঁচানোর কথা ভাবছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নার্গিস মোহাম্মদিও ইসরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তেহরানের নির্দিষ্ট এলাকায় বাসিন্দাদের সরে যেতে ইসরায়েলের ঘোষণার জবাবে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, আমার শহরকে ধ্বংস করো না।
তেহরান ও শিরাজ থেকে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা দুই আন্দোলনকারীও এখনই কোনও বিক্ষোভের পরিকল্পনা নাকচ করেছেন। ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর যে ব্যাপক গণআন্দোলন হয়েছিল, তারা তাতে অংশ নিয়েছিলেন।
শিরাজের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, যুদ্ধ শেষ হলে আমরা আবার আওয়াজ তুলবো। কারণ এই সরকারই সংঘাতের জন্য দায়ী।
আন্দোলন করায় কারাভোগের পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হওয়া অপর এক অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, আমি সরকার পরিবর্তনের পক্ষে। কিন্তু এখন রাস্তায় নামার সময় নয়। তিনি বহির্বিশ্ব থেকে আন্দোলনের ডাক দেওয়া নেতাদেরও অবিশ্বস্ত বলছেন। তার মতে, তাদের চিন্তা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে, ইরানের জনগণকে নিয়ে নয়।
নির্বাসিত বিরোধীদের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও স্পষ্ট। পাহলভীর নেতৃত্বে রাজতন্ত্রপন্থিদের বাইরে আরেক শক্তি হলো পিপলস মুজাহিদিন অর্গানাইজেশন অব ইরান, সংক্ষেপে এমইকে বা এমকেও। ১৯৭০-এর দশকে তারা ছিল বিপ্লবী দল। কিন্তু ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে তারা ইরাকের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় অনেক ইরানিই তাদের ক্ষমা করেননি।
এই সংগঠনটির ছায়া সংগঠন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব রেজিস্ট্যান্স অব ইরান-এর নেত্রী মরিয়ম রাজাভি এই সপ্তাহে প্যারিসে এক সম্মেলনে আবারও বলেন, আমরা রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই না, আবার মোল্লাতন্ত্রও চাই না।
তবে এই বহির্বিশ্বভিত্তিক বিরোধী দলগুলোর ইরানের ভেতরে কতটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। অনেকেই এখনও ১৯৭৯-এর আগের সময়ের প্রতি নস্টালজিয়া প্রকাশ করলেও সেই সময়টা যারা মনে করতে পারা মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।
গত এক যুগে ইরানের অভ্যন্তরে গণআন্দোলন বিভিন্ন ইস্যুতে হলেও তা কখনোই সরকার পতনের পথে গড়ায়নি। ২০০৯ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের ফল নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল, ২০১৭ সালে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবিকা সংকটে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। আর ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে নারীদের অধিকারের প্রশ্নে দেশ উত্তাল হয়।
২০০৯ সালের আন্দোলনের মুখ্য নেতা মির হোসেইন মোসাভি বর্তমানে ৮৩ বছর বয়সী এবং দীর্ঘদিন ধরে গৃহবন্দি। তার নীতিগত অবস্থান ছিল ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে সংস্কার করা, যা এখনকার তরুণদের আন্দোলনের সঙ্গে মিল খায় না।
ইসরায়েলি হামলা ইরানের ভেতরে সরকারবিরোধী অসন্তোষকে উসকে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা এখনও গণআন্দোলনে রূপ নিচ্ছে না। আন্দোলনের সময়, পদ্ধতি, নেতৃত্ব—সবই প্রশ্নের মুখে। আর এই প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হবে, যতদিন আকাশ থেকে বোমা ঝরতে থাকবে।
জনগণের মৌলিক উদ্বেগ এখন নিরাপত্তা। পরিবর্তনের স্বপ্ন আছে, কিন্তু পথটা কেমন হবে, তা নিয়ে দ্বিধা প্রবল। যতক্ষণ না যুদ্ধ থামে, ততক্ষণ সে উত্তর মিলবে না বলেই মনে করছেন অধিকাংশ ইরানি।