বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ছিলেন আইনুন্নাহার রিতা। একসময় তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু কেন দীর্ঘদিনের চাকরি ছেড়ে দিলেন, তা তার পরিবার বা সমাজ সেই সময় ভাবেনি। তখন যদি তা পর্যবেক্ষণ করা হতো তাহলে আজ দুই বোনের অবস্থা এমন হতো না।
দুই বোনের মধ্যে ছোট বোন মিতা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। তার মাধ্যমেই মূলত সন্দেহবাতিক অসুখে আক্রান্ত হন বড় বোন রিতা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয়, ‘শেয়ার ডেলিউশন।’ ছোট বোনের কাছ থেকে সন্দেহ বাসা বাঁধে এমন কথা দিনরাত শুনেই তিনি এ রোগে আক্রান্ত হন। তারা খুবই সন্দেহবাতিক, কাউকে ভালোভাবে নিতে পারেন না। তারা এক ভুলের মধ্যে বাস করছেন, যেখান থেকে তাদের যুক্তিপ্রমাণ দিয়ে সরানো যাবে না। আশেপাশের সবাইকে তারা সন্দেহ করে।
আলোচিত এই দুই বোনের মানসিক রোগ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘রিতা-মিতার মতো রোগীদের সামাজিক সহায়তা দরকার। প্রয়োজন সামাজিক পুনর্বাসন, যেটা তাদের ক্ষেত্রে হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকিৎসাক্ষেত্রের অনেক শাখায় উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি হলেও মানসিক রোগীদের সামাজিকভাবে পুর্নবাসন এবং সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রিতা শুধু বোনের সংস্পর্শে থাকার কারণে সে-ও সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। যদি পরিবার প্রথম দিকে রিতাকে আলাদা রেখে চিকিৎসা দিতো, তাহলে এত বছর তাকে রোগী থাকতে হতো না। পারিবারিকভাবে দায়িত্বশীল আচরণ করা হলে অনেক আগেই রিতা সুস্থ হতে পারতেন।’
যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে সিজোফ্রেনিকরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিমাত্রায় লাজুক এবং এককেন্দ্রিক মানুষই সিজোফ্রেনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়। আবার সিজোফ্রেনিয়ার পরিবারিক ইতিহাস রয়েছে, তাদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মূলত ১৫-৪৫ বছরের মধ্যে নারীদের গড় বয়স ৩২ হলেও পুরুষরা এ রোগে আক্রান্ত হয় ২৮ বছর বয়সে। আবার ‘লেট অনসেট সিজোফ্রেনিয়া’ বলেও একটি ধরন রয়েছে যা শুরু হয় এই বয়সের পরে।
তবে গবেষণা বলছে, নারীদের চেয়ে পুরুষরা সিজোফ্রেনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৫-২০০৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। এর মধ্যে বাংলাদেশে এই সংখ্যা ১৬ লাখের কিছু বেশি, যাদের বেশিরভাগই অবহেলার শিকার। এমনকি এ রোগে আক্রান্তরা সাধারণ মানুষের গড় বয়সের চেয়ে ১৫-২০ বছর কম বয়স বাঁচেন, অর্থাৎ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মৃত্যু হয় সাধারণ মানুষের তুলনায় আগে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে জানা যায়, রোগজনিত কারণে অক্ষমতার প্রথম ১০টি কারণের একটি হচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া। এ ধরনের রোগীদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা থাকে বেশি। এছাড়া ৪৫-৫৫ শতাংশ রোগী স্থূলতায় ভোগেন। তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের হারও অন্যদের তুলনায় বেশি হয়। এমনকি তাদের নিয়মিত শারীরিক রোগকেও অবহেলা করা হয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদী মনোসমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের বায়ো-সাইকো সোশ্যাল (মনোদৈহিক সামাজিক) চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে কেবলই দৈহিক রোগের চিকিৎসা হয়, সেখানে মনের খবর থাকে না। রোগী এবং পরিবারের সদস্যদের কাউন্সিলিংয়ের কোনও উদ্যোগ আমাদের দেশে নেই। সোশ্যাল থেরাপি দেশে একেবারেই অনুপস্থিত, আমরা এ বিষয়ে উদাসীন বলা চলে।’
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে সামাজিকভাবে কাউন্সিলর ও সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার রয়েছে, তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগীদের আবাসন, খাদ্য এবঙ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাদের সর্ম্পক ঠিক রয়েছে কিনা তা দেখেন। বায়োলজিক্যাল ও সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসার ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি হলেও সামাজিক চিকিৎসা কিংবা রোগীদের সাহায্য-সহায়তার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। সময় এসেছে এদিকে নজর দেওয়ার।’
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব জানান, সিজোফ্রেনিয়া একটি ক্রনিক ডিজিজ। সাধারণত সিজোফ্রেনিয়ার এক-তৃতীয়াংশ রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়, এক-তৃতীয়াংশের সুস্থতা ভালো-খারাপের মাঝামাঝি থাকে আর বাকি এক-তৃতীয়াংশ কখনোই সুস্থ হয় না।
ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব আরও বলেন, ‘সিজোফ্রেনিক রোগ সর্ম্পকে ভালো ধারণা রাখতে হবে সবাইকে। বিশেষ করে কখন, কীভাবে এই রোগীদের সহযোগিতা দরকার হয় তা জানা জরুরি। আরেকটি হলো— অন্য দশটা রোগের ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজ যেমন সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়, এই মানসিক রোগীদের বেলায়ও ঠিক একইরকম দায়িত্বশীলতা দেখাতে হবে। সেই দায়িত্বগুলো আমাদের নিতে হবে। পরিবারের একজন সদস্যের ক্যানসার হলে যেভাবে অন্যরা দায়িত্ব পালন করেন, একজন মানসিক রোগীর ক্ষেত্রেও একই মানসিকতা দেখাতে হবে। নয়তো রিতা-মিতার সংখ্যা আরও বাড়বে, কারণ তাদের দায়িত্ব কেউ নেয়নি।’
আরও পড়ুন-