স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া পিপিই সেটে ‘পলিথিন ব্যাগ’!

 

2

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ চিকিৎসক। তবে তাদের কোনও জটিলতা নেই, তারা ভালো আছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেওয়া পিপিই (পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) আর নকল এন-৯৫ মাস্ক পরেই আইসোলেশন ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করেছেন, আর সেখান থেকেই তারা সংক্রমিত হয়েছেন। এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগবিদ্যা বিভাগের একজন সহকারী রেজিস্ট্রার আক্রান্ত হওয়ার পর জানা গেছে, তিনি হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা পিপিই পরে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা সন্দেহভাজন করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। এভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সরবরাহ করা পিপিই পরেই যখন একের পর এক চিকিৎসক কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হচ্ছেন, তখন সে পিপিইর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

একাধিক হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা পিপিই পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু সেগুলা খুবই নিম্নমানের। তারা বলছেন, করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেলে এসব পিপিই কোনও কাজে আসবে না। প্রথমদিকে চিকিৎসকদের কেউ কেউ এ নিয়ে কথা বললেও এখন শোকজসহ নানা হয়রানির আতঙ্কে মুখ খুলছেন না।

একাধিক চিকিৎসক অভিযোগ করে বলেন, অধিদফতরের দেওয়া পিপিই সেটে মাস্ক আর গগলস নেই। আবার কারোটাতে কেবল গাউন আর সার্জিক্যাল মাস্ক আছে, নেই সু-কাভার, হেডকাভার। এভাবে একেকটা পিপিই সেটের ভেতর থেকে এসব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কোথায় গেল—সেটা খুঁজে দেখা দরকার বলেও মনে করছেন তারা। চিকিৎসকরা বলছেন, ডিউটি করতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই, কেবল প্রোপার পিপিইর দাবি জানাচ্ছি। নয়তো চিকিৎসকরা কী করে সেবা দেবে? পিপিই ধুয়ে শুকিয়ে ব্যবহার করছেন বলেও জানান তারা। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হচ্ছে, এসব পিপিই একবার ব্যবহারের পর ধ্বংস করে দিতে হবে।

1

১৮ এপ্রিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের এক জরিপের ফলাফল জানিয়ে গবেষক বুশরা জেরিন ইসলাম বলেছেন, সামনের সারিতে থাকা ৭৫ ভাগ চিকিৎসক ও ৪০ ভাগ নার্স পিপিই পেয়েছেন। কিন্তু রেইনকোটের মতো যে পিপিই দেওয়া হয়েছে, সেটা আদৌ কাজ করে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তারা।

বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ প্রতিবেদককে তাদের সরবরাহ করা পিপিইর ছবি পাঠিয়েছেন। তারা বলছেন, পিপিইর ভেতরে থাকা মাস্ক-ক্যাপ-গ্লাভস-গাউনের কোয়ালিটি একেবারেই নিম্নমানের। এমনও হয়েছে যে গ্লাভস পরতে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে। আবার কোভিড হাসপাতালগুলোতে নিম্নমানের পিপিই দেওয়া হলেও নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে অপ্রতুলতা রয়েছে, এটা প্রচণ্ড চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য।

কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম পুরান ঢাকার মহানগর হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলাম মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এই হাসপাতালে বর্তমানে ৫০ জন রোগীর মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী রয়েছেন ৩৮ জন আর বাকি ১২ জন সাসপেক্টেড।

তিনি জানান, তাদের এক সেট করে পিপিই দেওয়া হচ্ছে কিন্তু তার মান প্রশ্নবিদ্ধ। এই পিপিইতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাস্ক, দ্বিতীয় গ্লাভস এবং তৃতীয় হেডকাভার। অথচ গ্লাভস দেওয়া হয়েছে উন্নতমানের মোটা পলিথিনের। এগুলোই ব্যবহার করা হচ্ছে, এছাড়া তো কোনও উপায়ও নেই।

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, হোটেলে খাবার দেওয়ার সময় যে পাতলা পলিথিন পরে খাবার দেওয়া হয়, সে পলিথিনের তৈরি গ্লাভস দেওয়া হয়েছে, অনেকগুলো ছিঁড়েও গেছে, এগুলো পরা আর না পরা সমান কথা। স্বাস্থ্য অধিদফতর নিজেদের অপারগতার কথা স্বীকার করে নিক, আমারও তাদের পাশে থাকবো। কিন্তু তারা আমাদের বিপদে ফেলে মিডিয়ায় গালভরা গল্প শোনাচ্ছেন, এটা মেনে নিতে কষ্ট হয় আর নিজেরা লজ্জা পাচ্ছি এগুলো দেখে—বলেন একাধিক চিকিৎসক।

ডা. আমিনুল ইসলাম মহানগর হাসপাতালের আগে ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ওখানকার অবস্থা ছিল আরও খারাপ। বিভাগ থেকে ওয়ানটাইম ইউজ করার জন্য পিপিই দেওয়া হয়েছিল, যেখানে ছিল কেবল গাউন আর সার্জিক্যাল মাস্ক। আবার কোথাও কোথাও মোটা রেইনকোটের মতো দেওয়া হয়েছে, মাস্ক ছাড়া আমি নিজে এটা ব্যবহার করে এসেছি। তিনিই জানালেন, একজন ওয়ার্ডবয়ের পিপিই সেটের ভেতরে স্যু-কাভার হিসেবে ছিল বাজার করার পলিথিনের ব্যাগ।

3

আমাদের কোনও পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না, যদি প্রস্তুতি থাকতো তাহলে ধীরে ধীরে পিপিই কেনা শুরু হতো, তখন সুযোগ থাকতো মানসম্পন্ন পিপিই কেনার—মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তারপরও যদি এটা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা হতো তাহলেও কথা ছিল, কিন্তু যেহেতু পুরো বিশ্বের সমস্যা, সবার পিপিই দরকার, তাই বিশ্ববাজারেই এর ঘাটতি রয়েছে। আমরা যখন সোচ্চার হচ্ছিলাম, পিপিই লাগবে বলে, তখনও সংশ্লিষ্টরা মনোযোগ দেননি, গুরুত্ব দেননি। বরং তারা বলেছেন, সবার পিপিই দরকার নেই। পরে যখন রোগী বাড়তে শুরু করে তখন স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্যোগ নেয়, কিন্তু তখন বিশ্ববাজারে মানসম্পন্ন পিপিই নেই। আর স্বাস্থ্য বিভাগ যখন উদ্যোগ নেয়, তখন ব্যবসার আড়ালে চলে এলো অনৈতিকতা। মানসম্পন্ন জিনিস না তৈরি করে তখন সেগুলোকেই চালিয়ে দেওয়া হলো। আর যেহেতু এটা জরুরি পরিস্থিতি, নিয়ম মানার সময় নেই, তাই হয়তো স্বাস্থ্য বিভাগকে বাধ্য হয়েই এসব নিতে হয়েছে।

শেরে-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অনারারি মেডিক্যাল অফিসার ডা. মো. ফয়সাল ইসলাম ফাহিম বলেন, আমাদের পিপিই-এর নামে যে স্যুট দেওয়া হয়েছে তা কোনও আদর্শ হাজমাত স্যুট না, সেটা দেশি একটা কোম্পানির বানানো রেইনকোট।  ‘ফ্রগটগ’ নাম সম্ভবত কোম্পানিটার, সারা বছর স্পেশালি বর্ষার সময় পাওয়া যায়। যে গগলস দেওয়া হয়েছে তা বাচ্চাদের খেলনা চশমার মত পাতলা একটা প্লাস্টিকের গ্লাস। মাস্ক হিসেবে আদর্শ এন-৯৫ এর বদলে দিয়েছে পাতলা গেঞ্জির কাপড়ে সেলাই করা জোড়াতালি মাস্ক যা দিয়ে ধুলা কিছু আটকালেও কখনও কোন ভাইরাস আটকাবে না।

মানহীন এসব পিপিই নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল-ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসান ও পরিচালক (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) ডা. হাবিবুর রহমানকে একাধিকবার কল করে এবং এসএমএস পাঠিয়েও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।