দেশে বছরে কতজন আত্মহত্যা করে, তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যান নেই। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষরা আত্মহননের পথ বেছে নিলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। এ দেশে আত্মহত্যা যতটা না মানসিক অসুস্থতা হিসেবে ধরা হয়, তার চেয়ে বেশি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে বেঁচে যাওয়া প্রাণ বঞ্চিত হয় চিকিৎসার। এমন প্রেক্ষাপটে দেশে আজ মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’। ‘মানসিক স্বাস্থ্য একটি সর্বজনীন মানবাধিকার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হচ্ছে দিনটি।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম থিওরি অব সু্ইসাইডে বলেছেন, যখন সমাজে ব্যক্তির ওপর মূল্যবোধের প্রভাব হারিয়ে ফেলে, তখন তাকে নৈরাজ্যমূলক অবস্থা বলে। এ ধরনের পরিস্থিতি হলে ব্যক্তি তার নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী আচরণ করে, এতে সামাজিকভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে বা কারণে অনেকে আত্মহত্যা করে। এ রকম পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করাকেই নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা বলে।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি-১৮৬০-এর ৩০৬ ধারা অনুযায়ী, ব্যক্তির আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তি ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা। তবে আত্মহত্যা করতে গিয়ে মারা না গেলে আপনাকে আত্মহত্যা বা নিজেকে ধ্বংস করার অপচেষ্টার অপরাধে এক বছরের জেলে যেতে হতে পারে। দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা মতে, যদি আপনি আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নেন এবং একই ধরনের অপরাধ করার উদ্দেশ্যে কোনও কাজ করেন, তাহলে আপনার এক বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে কিংবা উভয় শাস্তিই হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার চেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে দেখার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। বেশিরভাগ আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক অসুখের সম্পর্ক থাকে। অথচ দেশের আইনে আত্মহত্যাকে এখনও একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রতিবেশীসহ অনেক দেশে এটিকে নিরপরাধীকরণ করে একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আত্মহত্যায় যারা মারা যান, তাদের প্রায় অর্ধেকের বেশি বিষণ্ণতায় থাকেন। আর আত্মহত্যার চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়া ব্যক্তির চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করে—এই ফৌজদারি আইন।
বাংলাদেশে এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম ইয়াসির আরাফাত ও তার গবেষক দলের পরিচালিত কেস-কন্ট্রোল পদ্ধতির মনস্তাত্ত্বিক ময়নাতদন্তভিত্তিক একমাত্র গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণকারীদের ৬১ শতাংশের ক্ষেত্রে অন্তত একজনের মানসিক রোগ ছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে বিষণ্ণতা রোগ, যা ৪৪ শতাংশ। এছাড়া ছিল ব্যক্তিত্বের রোগ, অ্যামফিটামিন (ইয়াবা) ব্যবহারজনিত রোগ, তীব্র মানসিক চাপ জনিত রোগ, অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার এবং সিজোফ্রেনিয়া। মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে জীবনে—এমন ঘটনা ছিল ৯১ ভাগ আত্মহত্যাকারীর। এই গবেষণায় প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল—শিক্ষাগত ব্যর্থতা, পারিবারিক কলহ, স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য, বাগদান ভেঙে যাওয়া, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামী বা স্ত্রীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, বড় ঋণের বোঝা, যৌন নির্যাতন, বড় শারীরিক অসুস্থতা, বিবাহ বিচ্ছেদ, ব্যবসায়িক ব্যর্থতা, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি।
অপরদিকে বেসরকারি সংগঠন ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’র দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৪০৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর এবং নারীর সংখ্যা বেশি। অভিমান থেকে আত্মহত্যার সংখ্যা এখানে বেশি।
অধ্যাপক ডা. এস এম ইয়াসির আরাফাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আত্মহত্যা ফৌজদারি অপরাধ। এটাকে নিরপরাধীকরণ করা প্রয়োজন। কারণ, ক্রিমিনাল অফেন্স হলে মানুষ প্রকাশ করতে ভয় পায়। এখানে আরও বিষয় হচ্ছে—যেহেতু ক্রিমিনাল অফেন্স, এক্ষেত্রে বেঁচে যাওয়া রোগীরা যখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায়, বেসরকারি হাসপাতাল ভর্তি নেয় না এবং ফাইলের ওপর পুলিশ কেস সিল মেরে দেয়। এজন্য এই রোগীরা খুবই মানবেতর উপায়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। একটু সুস্থ হলেই পুরোপুরি চিকিৎসা না নিয়ে পালিয়ে যায়। এটা আসলে নিরপরাধীকরণ করা খুবই জরুরি। এখানে গণমাধ্যম অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপে আত্মহত্যা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর সব দেশে এটি নিরপরাধীকরণ করা হয়েছে। ২০২২ সালে পাকিস্তানে এবং ভারতে ২০১৭ সালে এটি করা হয়েছে। নেপালে এটি কখনোই ফৌজদারি অপরাধ ছিল না। শ্রীলঙ্কায় ১৯৯০ সালে এটি করা হয়েছে। সুতরাং, এই নিরপরাধীকরণ খুবই জরুরি। কারণ, আত্মহত্যার ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও মানসিক রোগ থাকে। আমাদের ছোট আকারে করা একটি গবেষণায় পেয়েছি, এর পরিমাণ ৬১ শতাংশ।’
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশনের (আইএএসপি) মতে, আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা—মানুষকে আত্মঘাতী চিন্তাভাবনায় কাজ করা থেকে বিরত রাখে না। বরং এটি কেবল তীব্র সংকটের সময় তাদের কাছে পৌঁছানো এবং সহায়তা চাওয়া থেকে বিরত রাখে। বিশ্বের অন্তত ২০টি দেশে আত্মহত্যা একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, যার কিছু আইন ১৬০ বছর আগের।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও প্রখ্যাত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেদায়েতুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়। কারণ, তাদের তো সাহায্য দরকার। যিনি মারা গেছেন সে তো গেলেনই, বেঁচে থাকলে তাদের নিবিড় যত্ন দরকার। কারণ, একটা ক্রাইসিস মুহূর্ত সঠিকভাবে পরিচালনা না করতে পারার কারণেই কিন্তু আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিরপরাধীকরণের মাধ্যমে আইনি বিধিনিষেধ ও সামাজিক নিন্দার ভয় কমিয়ে এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি করে, আত্মহত্যার ব্যাপারে জনসাধারণের মনোভাব পরিবর্তন করা যেতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশে আত্মহত্যা প্রতিরোধ কার্যক্রমকে আরও জোরদার করার জন্য তথ্যবহুল গবেষণা, গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা, ভুক্তভোগীর জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা, আত্মহত্যার কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরি, সচেতনতা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, আত্মহত্যার জন্য ব্যবহৃত সামগ্রীগুলোর সহজলভ্যতা কমানো, জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশল প্রণয়ন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে ব্যাপক ও সমন্বিত প্রচেষ্টা সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।’