মানসিক রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজন হয় সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং। সাইকোথেরাপিস্টরা এই সেবা দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এজন্য তাদের সাধারণ কোর্স সম্পন্ন করার পরও উচ্চতর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এদিকে দেশে চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা দিতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অনুমোদন প্রয়োজন হলেও মানসিক রোগীদের এ সংক্রান্ত থেরাপি দেওয়ার অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনও কর্তৃপক্ষ নেই। এ সুযোগে অনেকেই শুধুমাত্র একটি কোর্স করেই চেম্বার খুলে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। আর তাতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এই খাত। কারণ, চিকিৎসকদের মতে, ভুল থেরাপি দেওয়া হলে ডেকে আনতে পারে গুরুতর বিপদ। তাছাড়া এই সেবা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
মানসিক চিকিৎসার একটি অংশ হচ্ছে কাউন্সেলিং। ওষুধ দিয়ে সবকিছু পরিবর্তন করা যায় না বলেই প্রয়োজন হয় সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের। চিকিৎসকদের মতে, মনের গভীরে এমন কিছু চিন্তা-বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গি, চরিত্র বা স্বভাব আছে, যেগুলো বদলাতে হলে এক ধরনের মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে তাদের চিন্তা-মনন, মেজাজ, ব্যক্তিত্বসহ অনেক কিছুই বদলে দিয়ে পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তন আনতে গেলে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং লাগে। অর্থাৎ মানসিক রোগীদের আচরণগত অনেক সমস্যা আছে, মানসিক সমস্যা আছে। তাদের আচরণগত মন, আবেগ, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং করতে হয়। এই কাজটি চিকিৎসকরা করতে পারেন না, তাই প্রয়োজন হয় থেরাপিস্টদের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরা এই কাজটি করে থাকেন। তবে সেজন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাইকোথেরাপি মূলত সাইকোলজিস্টরা দিয়ে থাকেন। তবে বাংলাদেশ আর বিদেশের ক্ষেত্রে এখানে পার্থক্য আছে। বাংলাদেশে এখনও কোনও সার্টিফিকেশন অথরিটি নেই। আমাদের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ থেকে যারা পাস করেন, তারা কাজ করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটে আসা রোগীদের আমরা কাউন্সেলিং করি। যাদের ওষুধ প্রয়োজন হয়, তাদেরকে আমরা হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকের কাছে রেফার করে দেই। আমাদের এখানে সেবা দেই মূলত যাদের ওষুধের প্রয়োজন নেই। মনোচিকিৎসক যারা রেফার করেন— তাদের কাছ থেকেই বেশি রোগী পাই। সাইকোথেরাপি তারাই দিতে পারেন— যাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ আছে। এটা এমন না যে, একটি কোর্স কিংবা ট্রেনিং করলাম তারপর সাইকোথেরাপিস্ট হয়ে গেলাম। বেশ কিছু স্তর আছে প্রশিক্ষণের, সেগুলো পার হওয়ার পর যোগ্যতা অর্জন করে থেরাপি দেওয়া যায়। অনুমোদনের কোনও কর্তৃপক্ষ না থাকায় বাংলাদেশে ইতোমধ্যে অনেকেই একটা কোর্স করে চেম্বার খুলে বসছে। এতে যে ক্ষতিটা হবে যারা সেবা নিচ্ছে— তাদের এই সেবা সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা হবে।’
এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম ইয়াসির আরাফাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাইকোলজিস্টরা থেরাপির কাজ করতেই পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে থেরাপিস্টরা কোনও ওষুধ দিতে পারবেন না। সুতরাং, ঝামেলা হবে তখনই, যখন তারা ওষুধ প্রেসক্রাইব করা শুরু করবেন। আরেকটি ঝামেলা হবে যখন সাইকোথেরাপিস্ট সবকিছু নিজেই বুঝতে চাইবেন। কারণ, সাইকোলজিস্ট অনেক ক্ষেত্রেই বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাউন্সেলিংয়ের ক্ষেত্রে সবারই একটু সতর্ক থাকতে হয়। যখনই সাইকোথেরাপিস্ট বুঝতে পারবেন যে, রোগী সামলাতে কষ্ট হচ্ছে, কিংবা প্রফেশনাল বাউন্ডারি অতিক্রম করছেন, তখন উচিত হবে অন্য সহকর্মীর কাছে রেফার করা। যদি যথাযথভাবে রোগী হ্যান্ডেল না করা যায়, তখন ঝামেলা হবেই। এ রকম অনেক নজির আছে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘সাইকোথেরাপির জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি একটি সাবজেক্টই আছে, যারা সাইকোলজি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে রোগী হ্যান্ডেল করা শিখে। অনেকেই ট্রেনিং ছাড়া নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী রোগী সামলাতে চান, কিন্তু সেটা সহায়ক হয় না।’