নিখোঁজদের তালিকা তৈরি নিয়ে বিভ্রান্তি!

নিখোঁজনিখোঁজদের খোঁজা নিয়ে কখনও আগ্রহ দেখা যায়নি পুলিশের। অনেকেই সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে থানা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন। তাতেও পুলিশ তেমন একটু গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর টনক নড়ে পুলিশের। জানা যায়, হামলাকারী জঙ্গিরা দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিল। পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না। এরপরই পুলিশ সদর দফতর থেকে দেশের সব থানায় নিখোঁজদের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই তালিকা তৈরি নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি।
কিভাবে তৈরি হবে নিখোঁজদের তালিকা জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, বিষয়টি সময় সাপেক্ষ। তবে সারাদেশে নিখোঁজদের তালিকা তৈরি করা পুলিশের জন্য অসম্ভব কিছু নয়। যারা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন, সেই আইনি পথ ছাড়াও পুলিশের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিখোঁজদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে থানাগুলো। তবে পুলিশের এ কার্যক্রম সফল হবে কিনা—তা নিয়ে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা সন্দিহান। তারা বলছেন, এতে সমাজে অন্যরকম একটা ভীতি ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহায়তায় নিখোঁজদের তালিকা তৈরির কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এছাড়া নিখোঁজদের তালিকা তৈরিতে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা নেওয়া হবে। অনেক সময় ব্যক্তিগত কারণেও অনেকে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে আত্মগোপনে থাকেন। সেগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিবারের লোকজন স্বেচ্ছায় গোপন রাখেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর যারা আর ফিরে আসেননি, তাদের ব্যাপারেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ভূমিকা কী হবে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গোয়েন্দারা জানান, গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি নিবরাস ইসলাম (২০), মীর সামেহ মোবাশ্বের (১৯), রোহান ইবনে ইমতিয়াজ (২০), খায়রুল ইসলাম পায়েল (২২) ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল দীর্ঘদিন থেকে নিখোঁজ ছিল। এক্ষেত্রে তাদের অনেকের পরিবার থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেও পরে আর এ বিষয়ে তারা কোনও যোগাযোগ করেনি। এছাড়া শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় জড়িত জঙ্গি আবির রহমান ও শফিউল ইসলামও দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিল। কিন্তু তাদের পরিবারের পক্ষ থেকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি জানানো হয়নি।

গোয়েন্দারা আরও জানান, গুলশান হামলার পর যে ১০ তরুণের নিখোঁজ হওয়ার তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও বেরিয়ে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের মধ্যে আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। তার ব্রিটিশ পাসপোর্ট নম্বর-৫২৫৮৪১৬২৫। তামিম আহমেদ চৌধুরী কানাডার পাসপোর্টধারী। সেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক। জুবায়েদুর রহিম ধানমণ্ডির লেকহেড গ্রামার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ওই স্কুলটি হিযবুত তাহরির নেতা সৈয়দ গোলাম মাওলার স্ত্রী জেনিফার আহমেদ পরিচালনা করতেন।

রাজধানীর কয়েকটি থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা আগে নিখোঁজ সংক্রান্ত সাধারণ ডায়েরিগুলোর একটি তালিকা তৈরি করছেন। এরপর তারা নিজস্ব সোর্স ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এলাকায় খোঁজ নেওয়া শুরু করবেন কোথায় কে নিখোঁজ রয়েছে।

সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার কামরুল আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিখোঁজদের তালিকা তৈরি পুলিশের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। যারা সাধারণ ডায়েরি করবেন সেই প্রক্রিয়ায় কিছু নাম বেরিয়ে আসবে। এছাড়া পুলিশের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি রয়েছে। সেসব পদ্ধতি ব্যবহার করে কোন এলাকায় কে নিখোঁজ রয়েছে, সেই তথ্য বের করা হবে। এরপরই নিখোঁজদের একটি তালিকা তৈরি করে তারা পুলিশ সদর দফতরে পাঠাবেন।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার মো. ইকবাল বাহার নিখোঁজদের তালিকা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা সব ধরনের নিখোঁজের তথ্যই সংগ্রহ করতে শুরু করেছি। পরে কারা কী কারণে নিখোঁজ হয়েছে, তা জানা যাবে। এজন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া অ্যান্ড প্লানিং বিভাগের ডিআইজি এ কে এম শহিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিখোঁজদের তালিকা তৈরি করতে কিছু সময় লাগলেও এটা সম্ভব। সাধারণ ডায়েরি ছাড়াও তারা পুলিশের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোন এলাকায় কে নিখোঁজ রয়েছে, তা বের করা সম্ভব হবে।

নিখোঁজদের তালিকা তৈরি প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শামীম সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিখোঁজদের তালিকা তৈরিতে পুলিশ কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, এভাবে ঘোষণা দিয়ে তালিকা তৈরিতে জনমনে একটা ভীতির সঞ্চার হতে পারে। নিখোঁজদের তথ্য দিলে পরিবারগুলোকে কোনও হয়রানির শিকার হতে হয় কিনা, সেটা নিয়েও অনেকে শঙ্কিত।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, পুলিশের এ উদ্যোগ একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। এতে জনসচেতনতাও কিছুটা বাড়বে। এটা পজেটিভ দিক। তবে এ প্রক্রিয়ায়ই যে সব সফলতা আসবে, তাও নয়।


/এমএনএইচ/আপ-এজে/