চাহিদা থাকলেও সাইবার পুলিশ স্টেশন আটকে আছে যেখানে

 

সাইবার পুলিশ স্টেশন, ছবি সংগৃহীতদিন দিন সাইবার অপরাধ বাড়ছে। কিন্তু সাইবার অপরাধী শনাক্ত ও ভিকটিমদের তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না থানা পুলিশ। থানায় সেই ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট ও তথ্যপ্রযুক্তিতে (আইটি) দক্ষ পুলিশ সদস্য নেই। থানাকে নির্ভর করতে হয় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে থাকা সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ টিমের ওপর। আর সাইবার সংক্রান্ত মামলার তদন্ত ভারও দেওয়া হয় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে গড়ে ওঠা ছোট ছোট সাইবার টিমকে। কিন্তু এতে নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করতে সময় লেগে যাচ্ছে বেশি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সাইবার পুলিশ স্টেশন বা সাইবার থানা করার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে বিশেষায়িত এই থানার জন্য বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, গুগল, স্কাইপে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও ব্লগে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, অশ্লীল ছবি ও ভিডিও আপলোড এবং মেসেজ পাঠিয়ে প্রতারণার ঘটনাগুলোই মোটা দাগে সাইবার অপরাধ হিসেবে পরিচিত। সাইবার অপরাধের শিকার বেশির ভাগ মানুষই নিজেকে লুকিয়ে রেখে অপরাধীর হাত থেকে বাঁচতে চায়। কখনও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। তীব্র আক্রান্ত হলে মামলা করে।

পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে, দেশে সাধারণত ১৩ ধরনের সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে আছে–পারিবারিক বিদ্বেষ সৃষ্টি, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে বিরোধ তৈরি, উগ্র ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য প্রচার, ইউটিউবে অন্তরঙ্গ ভিডিও ও ছবি আপলোড, ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি, পাসওয়ার্ড বা গোপন নম্বর অনুমান করে আইডি হ্যাক, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইন এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং), অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনলাইন গ্যাম্বলিং (জুয়া)।

পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (সিডিএমএস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাইবার অপরাধের ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় তিন হাজার ৬৫৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭৫টি মামলা সাইবার ট্রাইব্যুনালে গেছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২২টির। মাত্র ২৫টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের লফুল ইন্টারসেপশন সেল (এলআইসি), ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিসিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাইবার অপরাধ তদন্তবিষয়ক সেল, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কাজ করে। তবে মামলার তদন্ত করেছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার চাচ্ছে সাইবার ক্রাইমের ভুক্তভোগী মানুষদের একটি ছাতার নিচেই সেবা দিতে। তাই তারা সাইবার পুলিশ স্টেশন বা থানা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সিআইডির সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে ঢাকাতে একটি সাইবার পুলিশ স্টেশন করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যাতে মানুষ সাইবার সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে এই স্টেশনে এসেই অভিযোগ জানাতে পারে। নির্দিষ্ট একটি জায়গা হলে তারা ভালো সেবা পাবে। সাইবার পুলিশ স্টেশন মামলা গ্রহণ, তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের মতো কাজ করতে পারবে।

সিআইডির সূত্রটি আরও জানায়, সাইবার পুলিশ স্টেশনের ইনচার্জ হবেন একজন পুলিশ সুপার। তার অধীনে তিনজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ১২ জন সহকারী পুলিশ সুপার, ২৪ জন পুলিশ পরিদর্শক, ৭২ জন উপপরিদর্শক, ১৮ জন সহকারী উপপরিদর্শক এবং ৪০ জন কনস্টেবলের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুবুর রহমান জানান, ‘সাইবার পুলিশ স্টেশন করার একটি প্রস্তাব আমরা সরকারের কাছে দিয়েছি। আশা করছি, দ্রুত এটি অনুমোদন পাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইবার পুলিশ স্টেশন রয়েছে। আমাদের দেশেও প্রয়োজন। কারণ সাইবার অপরাধ বাড়ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ঢাকাতে একটি সাইবার পুলিশ স্টেশন করবো। এখানে সারাদেশ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত যে-কেউ অভিযোগ দিতে পারবেন। আমাদের জেলা অফিসে সিআইডি কর্মকর্তারা রয়েছেন, তাদের কাছেও অভিযোগ করতে পারবেন। সাইবার পুলিশ স্টেশনে করা অভিযোগগুলো আমরা কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করবো।’

স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, সিআইডির প্রস্তাবটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এটির আইনগত দিক যাচাই-বাছাই করছে মন্ত্রণালয়। করোনার কারণে বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত আসছে না। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উদ্যোগটি ভালো। তবে আইনগত বিষয় বিবেচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। তাই একটু বিলম্ব হবে।

পুলিশের যেমন বিশেষ ইউনিট করা হয়েছে। ঠিক সেভাবেই বিশেষ থানা করা দরকার মনে করেন সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা পিবিআইসহ বিশেষ কিছু নতুন ইউনিট করেছিলাম। সেগুলো সময়ের প্রয়োজনে করতে হয়েছে। ঠিক সেভাবেই সাইবার অপরাধ দমনে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার কাজ করছে। তারা এই সেন্টারের অধীনেই সাইবার পুলিশ সেন্টার করার প্রস্তাব দিয়েছে। এই উদ্যোগটা ভালো। সাইবার অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে এই পুলিশ স্টেশন ভূমিকা রাখতে পারবে।’

তিনি বলেন, ‘সিআইডির অধীনে যেহেতু সাইবার পুলিশ স্টেশন থানাটি পরিচালিত হবে, তাই এখনই বিধির প্রয়োজন নেই। থানা ঘোষণা আগেই হতে পারে। থানা হওয়ার পর এটি পরিচালিত হওয়ার জন্য বিধি প্রণয়ন করলেই হবে। এটা কী কী কাজ করবে? কীভাবে কাজ করবে? এসব বিষয় পরবর্তী সময়ে করা যাবে। বিধি প্রণয়নের বিষয়টি পরে আসবে।’