ব্যবসাকে পুঁজি করেই নেতা বনে যান হেলেনা

ব্যবসায়িক পরিচয় কাজে লাগিয়েই মূলত রাজনীতিতে আসেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে মেয়র পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েই প্রথমে পরিচিতি পান তিনি। এর সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সখ্য বাড়িয়ে নেতা হিসেবে নিজের পরিচিতি পোক্ত করেন। পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কাছাকাছি চলে আসেন ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের।

বিভিন্ন টকশোতে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলে সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন হেলেনা। এরইমধ্যে ২০২১ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্যপদ লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পান স্বীকৃতি।

কিন্তু সর্বশেষ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামে সংগঠন খুলেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। এর জেরে উপ-কমিটির সদস্যপদ হারান গত ২৬ জুলাই।

এদিকে বর্তমান মেয়াদে ব্যবসায়িক সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালকও হন তিনি। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন হেলেনা।

শুরুটা যেভাবে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই সময় গোটা ঢাকা তার পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। তখন তিনি দাবি করতেন, তার কোনও রাজনৈতিক দল নেই। স্বতন্ত্র রাজনীতি করতে চান। পরে অবশ্য ওই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।

এ সময় জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে নিজেকে 'সিস্টার হেলেন' পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন 'সামাজিক কার্যক্রম' চালাতে শুরু করেন হেলেনা। পাশাপাশি নিজের অননুমোদিত আইপি টিভি ‘জয়যাত্রা টেলিভিশন’-এর মাধ্যমে এর প্রচারও চালাতে থাকেন।

এ সময় মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে তার সখ্য হয় বলে জানা গেছে। পরে হেলেনা জাহাঙ্গীর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন ও আ ক ম মোজাম্মেল হককে বানান চেয়ারম্যান।

হেলেনা জাহাঙ্গীর নিজেই বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন, তিনি কখনও কোনও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে পারিবারিকভাবে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন বলে একাধিকবার দাবি করেন।

আরও পড়ুন: হেলেনা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে অপপ্রচারকারী সেফুদার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল: র‌্যাব

২০১৩ সালের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হন বলে ভিন্ন সময় জানিয়েছেন হেলেনা। রাজনীতিক হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছেন বলে একাধিক টকশোতে দাবি করেছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে তার বিভিন্ন ছবি স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে দেখা গেছে। অবশ্য হেলেনা এটাকে সামাজিক অনুষ্ঠানের ছবি বলেই দাবি করেছেন।

২০২০ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেন হেলেনা। মনোনয়ন না পেয়ে তিনি আর নির্বাচন করেননি। সর্বশেষ কুমিল্লা-৫ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে ফরম সংগ্রহ করেন। তবে সেবারও মনোনয়ন পাননি।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর প্রথমে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে এ বছর ১৭ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মনোনীত হন। আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যের সূত্র ধরে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর এফবিসিসিআইয়ের সদস্যপদ লাভ করেন। এর পরপরই এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক নির্বাচিত হন।

রাজনীতি ও ব্যবসা ছাড়াও হেলেনা জাহাঙ্গীর সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সক্রিয়। তার নিজের একটি ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডি আছে। তাতে ফলোয়ার আছে প্রায় দুই লাখ। নিয়মিত নিজের জয়যাত্রা টেলিভিশনে টকশোতে অংশ নিতেন।

ব্যবসায়ী হেলেনা

হেলেনা জাহাঙ্গীর একাধারে প্রিন্টিং, অ্যামব্রয়ডারি, প্যাকেজিং, স্টিকার এবং ওভেন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তিনি নিট কনসার্ন প্রিন্টিং ইউনিট, জয় অটো গার্মেন্টস লিমিটেড ও জেসি. এমব্রয়ডারি অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। জয়যাত্রা নামে একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনেরও মালিক তিনি। এ ছাড়া তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’রও সদস্য।

হেলেনা জাহাঙ্গীর গুলশান ক্লাব, গুলশান নর্থ ক্লাব, বারিধারা ক্লাব, কুমিল্লা ক্লাব, গলফ ক্লাব, গুলশান অল কমিউনিটি ক্লাব, বিজিএমইএ অ্যাপারেল ক্লাব, বোট ক্লাব, গুলশান লেডিস ক্লাব, উত্তরা লেডিস ক্লাব, গুলশান ক্যাপিটাল ক্লাব, গুলশান সোসাইটি, বনানী সোসাইটি, গুলশান জগার্স সোসাইটি ও গুলশান হেলথ ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

কেন এই পরিণতি?

সম্প্রতি হেলেনা জাহাঙ্গীর বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামক একটি ভুয়া ও ভুঁইফোড় সংগঠনের সভাপতির পদ পাওয়ার খবরে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। হেলেনা নিজেও ফেসবুক পেজে সংগঠনটির পক্ষে সাফাই গান। অবশ্য হেলেনা দাবি করেন, তিনি চাকরিজীবী লীগের সভাপতি নন।

ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপ-কমিটি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পদ থেকেও।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে দলের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করেন। দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও এসবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।

এদিকে দলীয় পদ হারিয়ে অনেকটা উত্তেজিত আচরণ শুরু করেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। একাধিক টকশোতে আওয়ামী লীগ নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। নিজের ফেসবুক পেজে লাইভে এসে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভেদ সৃষ্টির মতো উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এ সময় তাকে ব্যাপক কান্নাকাটি করতেও দেখা গেছে।

২৯ জুলাই রাতে তার গুলশানের বাসায় র‌্যাবের একটি টিম ব্যাপক তল্লাশি চালায় ও তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় তার বাসায় মাদক, পশুর চামড়াসহ বেশ কিছু অবৈধ জিনিসপত্র পাওয়া যায়।

এদিকে গুলশানের বাসা ছাড়াও তার মিরপুরস্থ জয়যাত্রা টেলিভিশনের কার্যালয় তল্লাশি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তাকে উপ-কমিটির পদ দেওয়ার আগে মেহের আফরোজ চুমকি আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি আমার কাছে তার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছি, আমি তাকে চিনি। সে ভালো, ব্যবসায়ী মানুষ।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি বাইরে থেকে যতটুকু দেখেছি ভালোই মনে হয়েছে। তবে ভেতরে কী আছে সেটা তো বলতে পারবো না।

জয়যাত্রা টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রশ্নে জানতে চাইলে সরকারের এই সিনিয়র মন্ত্রী বলেন, বছর তিনেক আগে আমাকে ওই টেলিভিশনের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের কাগজ দিয়েছিল। আমি তা গ্রহণ করেছিলাম। তবে এও বলেছিলাম, সরকারের পদে থেকে আমি এর সঙ্গে জড়িত হতে পারি কিনা? আর এখন তো ওটা অনুমতি পায়নি, অনুমোদন পাক তারপর দেখা যাবে।

আরও পড়ুন: যেসব মামলা হতে পারে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে

আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও দলের মহিলা বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য সচিব মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিষয়ে দলের উপরের পর্যায় থেকে সুপারিশ এসেছিল। আমি নিজেও দেখেছি তিনি একজন সিআইপি। প্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও তার কাজ করার আগ্রহ রয়েছে। এ ছাড়া তার দলের প্রাথমিক সদস্যপদ রয়েছে। সব মিলিয়ে তাকে উপ-কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যা দেখলাম তাতে আমি খুবই বিব্রত। পরে দলের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

হেলেনা জাহাঙ্গীরের এই পরিণতির কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিনি বেশ অস্থির প্রকৃতির। মানুষ ধীরে ধীরে উপরের দিকে যায়। কিন্তু তাকে দেখে মনে হয়েছে একবারেই বিশাল কিছু হতে হবে। নিজেকে ফলাও করতে চেয়েছেন। পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এখন যেহেতু বিষয়টি আইনি পর্যায়ে গেছে, বাকি যা হওয়ার তা প্রক্রিয়া অনুযায়ী হবে।’

আরও পড়ুন: জয়যাত্রা টেলিভিশন ঘিরে ছিল হেলেনা জাহাঙ্গীরের চাঁদাবাজি